অসুর: এক পরাজিত জাতির ইতিহাস

অসুর: এক পরাজিত জাতির ইতিহাস 

রূপায়ণ ঘোষ 

ভারত দেশটি যেমন বিপুল তেমনই সমৃদ্ধশালী তার ইতিহাস। নানান শাখা-প্রশাখায় সে ইতিহাসের ভিতর ছড়িয়ে রয়েছে অফুরান ঘটনা এবং তাদের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা। ভারতভূমির তেমনই এক অনালোচিত অধ্যায়- অসুর জাতির অকথিত, বিলুপ্তপ্রায় ইতিহাস।  আরও পরিষ্কার ভাবে বললে, ভারতবর্ষে বৈদিক সভ্যতার সূত্রপাত ঘটে সপ্তসিন্ধুর পূর্বাংশে সরস্বতী নদীকে কেন্দ্র করে। এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ ভাষ্যকার সায়নাচার্য বলেছেন, সমগ্র ঋগ্বেদে সরস্বতীকে 'দেবীতমাঃ' অর্থাৎ পবিত্রতম বা দেবী মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে সিন্ধু অথবা গঙ্গার এই প্রকার বিপুল ঐশ্বরিক স্তুতি ঋকবেদের কোথাও সেভাবে স্থান পায়নি। ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের আশেপাশে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে কৃষিভিত্তিক যে সভ্যতার সূচনা ঘটে; ঋগ্বেদ তার সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক উপাদান। ফলে পশুপালনবৃত্তিকারী এই গোষ্ঠীর যাবতীয় কার্যক্রম যে সরস্বতী নদীকে কেন্দ্র করে ছিল তা বলাই বাহুল্য। 

এই বেদপন্থী আর্যগোষ্ঠীরা মূলত 'দেব' ও 'অসুর' এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। হ্যাঁ, অসুর বলতে যে ধারণা বর্তমানে আমরা পোষণ করি তা সর্বৈব মিথ্যা এবং ভ্রান্ত। বিষ্ণুপুরাণের প্রথম সর্গের পঞ্চম অধ্যায়ে ব্যক্ত আছে,  সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার জঘন-দেশ (জঙ্ঘা) থেকে তমোগুণ সম্পন্ন অসুরদের জন্ম হয় রাত্রির অন্ধকারে। অন্যদিকে দিনের বেলায় ব্রহ্মার সত্ত্বোদ্রিক্ত অবস্থায় সাত্ত্বিকগুণ সম্পন্ন দেবতাদের জন্ম হয়- অর্থাৎ একই ব্যক্তি থেকে এই দুই গোষ্ঠীর উদ্ভব। এখন পুরাণের এই অতিরঞ্জিত গল্পকে সরিয়ে রাখলে, বাস্তব বুদ্ধিতে যে তত্ত্বটি সামনে আসে, তা হল একই গোষ্ঠীপতির ভিন্ন ভিন্ন পত্নী হতে উৎপন্ন দুই বৈমাত্রেয় ভাই হল দেব এবং অসুর। পরবর্তীতে যাঁঁরা নিজ নিজ দল বা গোষ্ঠীকে একটি বৃহৎ সম্প্রদায়ের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময় থেকেই বৈদিক আর্যদের মধ্যে অগ্নিপূজার প্রচলন ঘটে।  প্রথমদিকে দেব ও অসুর উভয়পক্ষই অগ্নিপূজা বা যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতেন; পরবর্তীতে মতান্তর এবং তা থেকে এক সার্বিক আদর্শ (Ideology) তথা সম্প্রদায়গত মনান্তরেরও সৃষ্টি হয় যাতে অসুরেরা যজ্ঞপ্রথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

খুব সম্ভবত এই বিচ্ছিন্নতার কারণ ছিল দেবতাদের পদস্খলন এবং আদর্শগত চ্যুতি। বৈদিক যুগের প্রথম পর্বে আর্যরা ছিল কৃষি ও পশুপালক জাতি। ফলে বৃষ, গাভী, বলদ, অশ্ব জাতীয় মূল্যবান পশুর যথেষ্ট জোগান তাঁঁদের ছিল এবং এই পশুসম্পদকে রক্ষা করার প্রবণতা অল্পকালের মধ্যেই ভারতে তাঁঁদের পায়ের তলার মাটিকে সশক্ত করে তোলে। কিন্তু পরবর্তীকালে যজ্ঞপ্রথা (Sacrifice) উদ্ভাবনের সাথে সাথে এই পশুসম্পদকে তাতে উৎসর্গ বা বলি দেওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। সম্ভবত অসুরগোষ্ঠী পশুসম্পদের এই অনৈতিক হানি ও সমাজের উচ্চপ্রভাবশালীবর্গের এমন কুকর্মকে সমর্থন করেনি। (লক্ষ করলে দেখা যাবে, জীবনধারণের জন্য শিকারবৃত্তি অবলম্বন করলেও বন্য জনজাতির মধ্যে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে শত শত পশুবলি দেওয়ার রীতি প্রায় নেই বললেই চলে) পাশাপাশি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের মতো গোষ্ঠীগত কোনও মতানৈক্যের কারণেই দেব এবং অসুর আলাদা হয়ে পড়ে। অতঃপর ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বপ্রথম ক্ষমতাতান্ত্রিক লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে। 

বেদে ১০৫ বার 'অসুর' শব্দের প্রয়োগ আছে, বলা বাহুল্য সবই ভালো বা উত্তম অর্থে প্রযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে যতদিন উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় ছিল ততদিন দেবতারা অসুর শব্দকে মর্যাদাব্যঞ্জক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মরুৎ, বরুণ, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবতারা বেদের প্রথমকালে বারংবার 'অসুর' সম্মানসূচক পদে ভূষিত হয়েছেন। মরুতের জন্য ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, 

"তে জজ্ঞিরে দিব ঋষ্বাস উক্ষণো রুদ্রস্য মর্যাসুরাঃ অরেপসঃ।" (ঋ: ১.৬৪.২)

বরুণ- "ত্বং বিশ্বেষাং বরুণাসি রাজা যে চ দেবা অসুর যে চ মর্তাঃ।" (ঋ: ২.২৭.১০)

অগ্নি- "প্রাগ্নয়ে বৃহতে যজ্ঞিয়ায় ঋতস্য বৃষ্ণে অসুরায় মম্ম।" (ঋ: ৫.১২.১)

বায়ু- "শৃণোত্বতূর্তপংথা অসুরো ময়োভূঃ"। (ঋ: ৫.৪২.১) 

 

কিন্তু নৈতিক দ্বন্দ্বের আরম্ভ হতেই সর্বপ্রকার সৌহার্দ্য সরে গিয়ে ঘৃণা ও ঈর্ষা প্রধান হয়ে দাঁড়ালো। পুরাণের ব্যাখ্যা অনুযায়ী 'অসুর' শব্দটির উৎপত্তি 'অসু' থেকে যার অর্থ প্রাণ। বায়ুপুরাণের নবম অধ্যায়েও অসুরদের উৎপত্তির কারণ হিসেবে ব্রহ্মাকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে- 

 

''ততোহস্য জঘনাৎ পূর্বমসুরা জজ্ঞিরে সুতাঃ।

 অসুঃ প্রাণঃ স্মৃতো বিপ্রাস্তজ্জন্মানস্ততোহসুরাঃ।।"

 

সুতরাং অসুর অর্থে সমস্ত অনার্য জাতি অশুভ কিংবা অমঙ্গলকারী এমন ভ্রান্ত ধারণার কোন যুক্তিই ধোপে টেকে না। কিন্তু যুগ যুগ ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্য এবং চিন্তা-চেতনা ক্রমাগত প্রচারের মাধ্যমে একটি মিথের প্রতিষ্ঠা দিতে সক্ষম হয়েছে- তা হল দেব-বিরুদ্ধ যে কোনও শক্তিই অশুভ, ভয়ঙ্কর, অনিষ্টকারী। কিন্তু এ বিচার তো কেবল দেবতাদের দৃষ্টিকোণ থেকে; যদি বেদ-পুরাণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলিকে আতশ কাচের তলায় ফেলা যায় তবে দেখা যাবে, দেবতাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ইন্দ্র পদাধিকারী শাসকেরাই সর্বাধিক অশুভ, অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংযুক্ত। গৌতমপত্নী অহল্যার সম্মানহানিই হোক কিংবা অমৃতভাগের সময় অসুরদের প্রবঞ্চনা- প্রতিটি ক্ষেত্রে দেবশাসক ইন্দ্রের অনৈতিক, স্বার্থান্বেষী চরিত্রটি সামনে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অবশিষ্ট দেবগোষ্ঠীও তাঁঁদের এই কুকর্মের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে সমস্ত রকম সহায়তা ইন্দ্রদেরকে (ইন্দ্রত্ব একটি পদ, কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়) প্রদান করেছে। সুতরাং দেব মাত্রই শুভ এবং অসুর অশুভ শক্তির প্রতীক- এটি একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী মনগড়া কাহিনি বা কুসংস্কার ব্যতীত আর কিচ্ছু না। 

বৈদিক যুগের শেষ পর্বে অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ অসুররা দেবতাদের থেকে পৃথক হয়ে পড়ে এবং ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে পারস্য (বর্তমান ইরান) অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এমতাবস্থায় দেবার্যরা (যেহেতু দেব এবং অসুর উভয়েই আর্য, তাই আমরা এদের ভাগদুটিকে দেবার্য ও অসুরার্য বলব।) সপ্তসিন্ধুসহ সরস্বতীর পূর্বদিকে বেশ কিছুটা অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হয়। যে সমস্ত অসুরেরা ভারতের বাইরে যেতে পারল না, তাঁঁরা ক্রমাগত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে হটতে ভারতের একেবারে পূর্বাংশে অরণ্যঘেরা ভূখণ্ডে এসে উপস্থিত হলো।  ছোটনাগপুর, ঝাড়খণ্ড, সিংভূম, ধলভূম-এর মতো বিস্তীর্ণ মালভূমি ও দুর্ভেদ্য অরণ্যাঞ্চল সেই মুহূর্তে দুর্বল, ছত্রভঙ্গ, রণক্লান্ত অসুরগোষ্ঠীর কাছে আত্মগোপনের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত স্থান হিসেবে যে বিবেচ্য হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

 

অন্যদিকে যেসব অসুরগোষ্ঠী ভারতের বাইরে যেতে সক্ষম হয়েছিল ক্রমে তাঁঁদের প্রভাব ও পরাক্রম এত ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যে প্রায় তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে ব্যাবিলনের কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমাংশে তাঁঁরা অসুর বা আসিরিয়া(Assyria) নামে একটি সুবিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করে। টাইগ্রিস নদীর উর্বর উপকূল অঞ্চলে গড়ে ওঠে এদের সুরম্য রাজধানী। এশিয়া মাইনর থেকে ককেসাস্ পর্বত পর্যন্ত এদের অধিকার বিস্তৃত হয়। এই আসিরীয় জাতির প্রাচীন সভ্যতার যে নিদর্শন পাওয়া যায় (মেসোপটেমিয়া অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত তাম্রনির্মিত সুরাপাত্র, এছাড়া ভাষাসমূহের ব্যবহার) তাতে প্রমাণ করা যায় এই সভ্যতা অনেকাংশেই সুমেরীয়দের কাছে ঋণী। অনেক  ঐতিহাসিকদের মতে, সুমেরীয়রাই দ্রাবিড় জাতির বিবর্তিত রূপ, অন্তত উভয় জাতির ব্যবহৃত ভাষা ও লিপিসমূহে তেমনই ইঙ্গিত মেলে। একটা বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে দ্রাবিড়রা ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন জনজাতি। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ Sir William Turner প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রমাণ করেছেন যে, দ্রাবিড়রা বহু আদিমকাল থেকেই ভারতবর্ষের অধিবাসী। সেক্ষেত্রে অসুর সভ্যতার একটি বৃহদাংশ যে প্রাচীন ভারতীয় জনজাতি এবং বহিরাগত আর্যরা তাঁঁদের পরাজিত করে ভারতের বিস্তীর্ণ ভূমিভাগ দখল করেন- এ তত্ত্ব যথেষ্ট প্রামাণিক বলে বোধ হয়।ব্যাবিলনের ল্যাগেশ নগরের তেল্লা(Tella) নামক স্থানে মাটির স্তূূপ থেকে কারুকার্যখচিত যে প্রাচীন রূপোর পাত্র, তাম্রদ্রব্য আবিষ্কৃত হয়- ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণাংশে অরণ্যাঞ্চল থেকে সেই একই আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সমন্বিত তাম্রযন্ত্র উদ্ধার হয়েছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সেখানকার স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, সেখানে অসুর জনজাতির রাজা মহিষাসুরের শাসন ছিল; খুব সম্ভবত আরও দক্ষিণে মহীশূর ছিল তাঁঁর রাজধানী। সপ্তসিন্ধু থেকে বিতাড়িত হয়ে অসুুুর সম্প্রদায় দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের গঙ্গা বিধৌত অরণ্যভূমিকে নিজেদের বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সেখানে ভারতের সবচেয়ে আদিম অনার্য জনজাতি কোল, ভিল, হো, মুুুণ্ডাদের সঙ্গে অসুরদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় একটি মিশ্র সংকর জাতির উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে হয়। কালক্রমে তাঁঁরা আবিষ্কার করল এই বিপুল বনাঞ্চল আসলে খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। বিশেষত লৌহ, তাম্র, স্বর্ণ, বক্সাইটের অজস্র খনি যে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একথা আজ আর কারোর অজানা নয়। অন্যদিকে গঙ্গার পলিযুক্ত উর্বর কৃষিভূমি ছিল আরেক লোভনীয় সম্পদ। এই সকল অফুরান বৈভবের মাঝে অসুদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা দেবতাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। মরু-অঞ্চল যুক্ত রাজস্থান, গুজরাট এবং বৃহৎ নদীহীন উত্তর-পশ্চিম ভারতে দেবতাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছিল। পুরাণে বর্ণিত দেবতাদের শ্রীহীন হওয়া ও দেবী লক্ষ্মীর পাতাল-প্রবেশ এই ঘটনাকেই সমর্থন করে। সমুদ্রমন্থন করে লক্ষ্মীর পুনরায় স্বর্গে ফেরত আসা স্রেফ একটা গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া কিছু নয়। অসুরদের দ্বারা মরু-অঞ্চল যুক্ত বৃহৎ নদীহীন, কৃষিহীন উত্তর-পশ্চিম ভারত (পুরাণে বর্ণিত অমরাবতী/স্বর্গ) আক্রমণের কোন যুক্তিযত কারণ পাওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে আজকের দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব অঞ্চলগুলি তৎকালীন সময়ে এত উন্নত ও জনাকীর্ণ ছিল না। বরং গঙ্গা-দোয়াবাঞ্চলের কৃষিজমি, বনজ সম্পদশালী ভূভাগ এবং বিপুল খনিজ ভাণ্ডারের লোভে দেবতাদের দ্বারা বারংবার অসুররাজ্য (দক্ষিণ-পূর্ব ভারত) আক্রমণের তত্ত্বটি অনেকবেশি যুক্তিসম্মত বলে মনে হয়। এমনই একটি লোকশ্রুতি- যা মধ্যপ্রদেশ, বাংলার উত্তরবঙ্গ, সিংভূম, ছোটনাগপুর অঞ্চলগুলিতে বহুলভাবে প্রচলিত তাতে জানা যায় সিংভূম থেকে গাংপুর স্টেট পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ তাম্রখনি (যা প্রত্নতত্ত্ববিদরা ১৯৪০-এর দশকে আবিষ্কার করেন) ছিল মহিষাসুরের শাসনাধীনে।  আজও স্থানীয় লোকেরা একে 'অসুরগড়' বলে উল্লেখ করে। এই বিস্তৃত অঞ্চল জবরদখলের জন্য দেবতারা বারবার আক্রমণ করলেও অসুরদের হাতে পরাজিত হয়। তখন উপায়ন্তর না দেখে 'দুর্গা' নামক এক রমণীর সাহায্য তাঁঁরা গ্রহণ করে। এই দুর্গা ছলে-বলে-কৌশলে-রূপে-দেহসৌন্দর্য্যৈ বীর অসুররাজকে প্রণয়াসক্ত করতে সক্ষম হয় এবং গভীর অরণ্য মাঝে সোহাগরত অবস্থায় নিরস্ত্র, অসতর্ক মহিষাসুরকে হত্যা করে। সেই কারণেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসুর জাতির লোকেরা আজও দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে আলো বন্ধ করে অন্ধকার রাত্রিতে ছিন্ন পোশাক পরিহিত হয়ে অশৌচ ও শোক পালন করেন। 

 

এই মহিষাসুরের সঙ্গে আসিরীয় সম্রাট অসুরবনিপালের যোগসূত্রকেও উড়িয়ে দেওয়া চলে না। প্রায় ৬৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে বিপুল পরিমাণ তামা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো, আসিরীয়রা তাম্র-প্রিয় জাতি তো ছিলই, তাঁঁদের ব্যবহৃত তাম্র-দ্রব্যে ভারতীয় তামার নানান বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করা গেছে। ভারত ও আসিরীয় অসুররা যে একই জাতি তা আরও কিছু তথ্য সহকারে প্রমাণ করা সম্ভব। প্রথমত, আসিরীয় অসুর সম্প্রদায়ের শ্মশান ছিল ডিম্বাকৃতি মৃৎপাত্রের মতো, স্থানে স্থানে গোলাকার। অন্যদিকে শতপথ-ব্রাহ্মণে দেখা যায় দেবতাদের শ্মশান ছিল বর্গক্ষেত্র, স্থানে স্থানে আয়তাকার। কিন্তু ভারতীয় অসুরদের শ্মশান ছিল গোলাকৃতি। 

 

"যা আসুর্য প্রাচ্যাস্ত্বদ যে ত্বৎ পরিমণ্ডালানি শ্মশানানি কুর্বতে।" 

                                                       - শতপথ-ব্রাহ্মণ (১৩.৪.১.৫) 

 

দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক Sclater ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসরণ করে দেখিয়েছেন, যে একজাতীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীদের পৃথিবীর পৃথক পৃথক ভূখণ্ডে থাকা সম্ভব নয়। হয় বিচ্ছিন্ন ভূ-খণ্ডগুলি সংযুক্ত ছিল অথবা একই সম্প্রদায়ভুক্ত প্রাণীর উৎসভূমি একটিই;  পরবর্তীতে হতে পারে জীবনচর্যার তাগিদে তাঁঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত থেকে রপ্তানিকৃত যে খনিজ ও বনজ সম্পদ আসিরীয় সাম্রাজ্যের জৌলুসকে মহামান্বিত করে তুলতে পারে; সেই বিপুল ধনভাণ্ডার ভারতীয় অসুর জাতিকে নিশ্চয়ই দরিদ্রতা দান করেনি। বরং অনেকবেশি বৈভব ও বিত্তের অধিকারী করে তুলেছিল। প্রকৃতপক্ষে এই অতুল ঐশ্বর্যের চমকে দেবগণের দ্বিতীয়বার পদস্খলন হয়। ফলস্বরূপ তারা প্রতিনিয়ত অসুরগোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে থাকে, বীরত্বের বদলে ছলনা ও মিথ্যাচারিতার আশ্রয় নিয়ে তাদের পরাজিত এবং বিতাড়িত করতেও সক্ষম হয়। নির্মিত হয় বিস্তৃত আর্যাবর্ত ও তার নিজস্ব ইতিহাস।  যাকে ধর্মগ্রন্থের রূপ দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে সমাজের একটি ঐতিহাসিক দিককে আবৃত করে রাখা হয়েছে। কারণ শত অপরাধ, অন্যায় সত্ত্বেও ইতিহাস এবং সমাজ, অস্ত্র তথা বিজয়ীর কর্তৃত্বকেই সর্বদা স্বীকার করে এসেছে।। 

 

                                     

 

তথ্যসূত্র: 

১. ঋগ্বেদ, অনুবাদ- রমেশচন্দ্র দত্ত।

২. Indian Malayia: contribution to the Carniology of the people of the empire of India, Sir William Turner 

৩. History of ancient indian religious texts, J.R. Carter

৪. Perspective in social and economic history of early India, R.S. Sharma 

৫. রচনাবলী (প্রথমখণ্ড), অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। 

৬. দেবতার মানবায়ন, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। 

 

                                     

 


1 টি মন্তব্য: