কার্পেথিয়ান উপত্যকার কবিতা - রূপায়ণ ঘোষ












কার্পেথিয়ান উপত্যকার কবিতা

রূপায়ণ ঘোষ


মিহাই এমিনেসকিউ। (Mi'haj emi'nesku)
১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রোমানিয়ার মোলডাভিয়ায় মিহাই এমিনেসকিউয়ের জন্ম হয়। ঐতিহাসিক নিকোলই লোগারের মতে মিহাই হলেন আধুনিক রোমানিয়ান ভাষার প্রাণপুরুষ। তাঁর কবিতায় মূলত পুরাণ, ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিক রহস্যময়তার এক বিস্তীর্ণ ইন্দ্রজাল বর্তমান। ১৮৮৯ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে রাজধানী বুখারেস্টে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।



মধ্যরাতের স্পর্ধিত ঘন্টাধ্বনি (Clopotele infrumusetate ale noptii)
 
মধ্যরাতের অন্ধকারে শোনা যায় স্পর্ধিত ঘন্টাধ্বনি
এখানে নিদ্রা যেন চেতনার চিরাচরিত প্রথার মতো;
তার নিজস্ব দুঃখ সংগ্রহ করে না আমাদের থেকে
বহু দীর্ঘ পথ অনুসরণ শেষে
জেনো, মৃত্যুই আমার আত্মাকে নেতৃত্ব দেবে।
এবং এই মরণ
যখন সমস্ত বিবেচনা শেষে খুঁজে পাবে
আসলে জীবনই সত্যের প্রতিরূপ-
শব্দেরা স্থির হবে, নীরব হবে আমার সুষম হৃদয়ে
দেখো তার অতৃপ্ত অভিমুখ ঘুরে যাবে না
জীবন ও মৃত্যুর কোনও একদিকে...
 

সমস্ত নক্ষত্রকে (Toate la stea)

গভীর আকাশ জুড়ে নীল হয়ে উঠছে অদূর নক্ষত্ররা। যে আলো ভীত চোখ ছুঁয়ে যাবে আমাদের, তা দেখার জন্য আরও সহস্র বছরের প্রয়োজন। বহু যুগ ধরে তাদের আভাসে আভাসে প্রবাহিত আকাশ- আরও বেশি নিমগ্ন হয়। তবুও কেবল নক্ষত্র রশ্মিগুলি মানুষের চোখ জুড়ে তাদের ছায়াচূর্ণ যাত্রা ছড়িয়ে রেখেছে। দ্যাখো ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে যাওয়া নক্ষত্র-প্রতিমাটি আরোহণ করে সুউচ্চ খিলান; এই সম্মুখে সময়ের আগেই আবিষ্কৃত হচ্ছে ধ্বংসের প্রতিভূ। তবুও আমাদের মায়াকামী প্রেমের আকাঙ্ক্ষা যখন রাত্রির আড়ালে তীব্র ঘন হয়, তারাদের নিভে আসা মৃদুল-প্রভা জ্বেলে রাখে আমাদেরই ক্ষীণতম প্রাণ।
 
 
পুরাতন মৃত্যুর গান (Cantec vechi de moarte)
 
কীভাবে মরতে হয় শিখে নেবো ভেবেছি
দ্যাখো, তাতে যৌবন চির-আবদ্ধ হবে হাতের মুঠোয়
এসো সেই স্বপ্নবদ্ধ চোখ তুলি নির্জনতম তারাটির দিকে,
তখনই আমার মসৃণ পথে এসে দাঁড়ালে তুমি
দ্যাখো অজানা আশঙ্কায় যন্ত্রণাবিদ্ধ চরাচর
এবং এই তীব্র দুঃখের কাছে
আমি মৃত্যুর খসড়াটি স্তব্ধ নামিয়ে রাখলাম।
শোচনীয়ভাবে আমি নেসাসের* মতো জীবিত পুড়ে যাচ্ছি
অথবা হেরাক্লেসের মতো জড়িয়েছি বিষাক্ত চাদর!
অথচ হৃদয়ে সীমাহীন সমুদ্রের মতো আগুন নেভেনি কখনো,
আমাকে গ্রাস করে স্বভ্রম স্বপ্নগুলি
শুরু হয় নিজস্ব বিলাপ-ক্রন্দন
নিজেরই আকাঙ্ক্ষা স্তূপে জ্বলে উঠছি ফিনিক্স যেমন-
বেদনায় ভিজেছে যে অশ্রুচোখ
তাও মুছে যাবে আমার পথ থেকে
আমার বুকের কাছে সরে এসো উদ্বেগহীন দুঃখেরা
যাতে শেষ পর্যন্ত মরে যেতে পারি শান্তিতে
নিজেকে ফিরিয়ে দিতে পারি আত্মার স্তব্ধ গভীর ক্রিয়ায়।
 
* প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে নেসাস হলেন একজন নরঘোটক। অর্থাৎ যাঁর মাথা মানুষের মতো এবং ধর অশ্বাকৃতির। পত্নী ডায়নারাকে অপহরণ করার সময় গ্রীকবীর হেরাক্লেস তাঁকে হত্যা করেন। পরবর্তীতে তাঁর বিষাক্ত রক্ত
​​হেরাক্লেসের মৃত্যুর কারণ হয়। নেসাস দেবতা সেন্টাওরোসের পুত্র ছিলেন। তিনি লাপিথ জনজাতিদের সঙ্গে যুদ্ধে লড়াই করেন এবং ইউয়েনস নদীর তীরে পাটনীর কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
 

 

 

 

আলেকজ্যান্দ্রু ম্যাসিডোনস্কি। (Alek'sandru mate'donski)
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে রোমানিয়ার সীমান্তবর্তী জনপদ ওয়ালাচিয়ায় ম্যাসিডোনস্কি জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন Symbolist Movement -এর প্রধান। ফ্রান্সের এই সাহিত্য আন্দোলনকে তিনি রোমানিয়ায় প্রতিস্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ম্যাসিডোনস্কি Instrumentalism চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন যা তথাকথিত ধ্রুপদী কবিতার বিরুদ্ধক্রিয়ারূপে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯২০ সালে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে ৬৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।






আমার ছন্দ (Rondelul meu)
 
যখন আমি ঘৃণিত ছিলাম- আরও সুদীর্ঘ মহানতা ছিল আমার
সমস্ত ঘটে যাওয়া সময়ের উপ‍র আমি আজ তীক্ষ্ণ প্রবল
নিজেকে ভালোবেসে আমিও তো মহান, দু্র্দান্ত-
তাই বিস্মৃতির সাথে ভাগ করি হারানো নিয়তি
হয়তো এই ক্রূরতা আরও তীব্র করে তোমাকে
পায়রার মতো উঁচুতে উড়ে যাও
যখন তোমার হৃদয়ে প্রেম ছাড়া কিছু নেই
যখন ক্ষমাই তোমার আত্মার আনন্দকারণ
তখনও আমি জানি,
এ পৃথিবীতে সমস্ত কিছু, দুঃখের ভার বহন করে চলে
কেবল বিপুল অজ্ঞতা নিয়ে আমরা
জীবনের মাঝে বেঁচে থাকি।
এখানে প্রতিটি প্রেমে সান্ত্বনা থাকে, যন্ত্রণা থাকে-
তবু তা প্রবল হয়, আনন্দ হয়: ক্ষমা ও বিস্মৃত হয়...
 

 
মৃত্যুরত গোলাপ (Trandafiri mortali)
 
ক্রমশ সময় গুছিয়ে নিচ্ছে মৃত্যুরত গোলাপ
ক্রমশ গভীর উদ্যানে মৃত আমি
আর আত্মাকেও ছুঁয়ে ফেলছে বিকীর্ণ মরণ
এত প্রাণোচ্ছ্বল সেইসব ফুলেরা
অথচ কী সহজে তারা সমাপ্ত হয়!
যেন বেজে ওঠে শোক-কম্পন
গোলাপের মৃত্যু দেখতে দেখতে, আরও গভীরে ধ্বংস হচ্ছি আমি
এই শোকার্ত গোধূলির নিচে
কম্পিত ঝর্ণা এবং আগত দুর্দান্ত রাত্রির দিকে
তাদের আনত চিবুক ঝুঁকেছে কোমলভাবে;
দ্যাখো, গোলাপের মৃত্যুর জন্য ধীরে ধীরে সজ্জিত হয়েছে সময়...
 

প্রেতবন্দনা (Iubirea de dragoste)
 
আশ্চর্য শূন্যতায় আমার প্রেয়সীকে
আকাশ ও ঢেউয়ের মাঝে ঠেলে দিল নিরলস সময়-
যে উদ্যত ত‍রঙ্গ তাকে দংশন করে
কখনও ঊর্ধ্বে অথবা নামিয়ে আনে আরও গোপন পাতালে
কখনও ঝুঁকে যায় অন্ধকার ভ্রান্তির দিকে!
বাতাসেরা আরও তীক্ষ্ণ চিৎকার করে অতল আঁধারে
তাদের বিবর্ণ আর্তরবে অনন্ত গহ্বরকণ্ঠের সাথে মিশ্রিত হয় কান্না
কখনও কখনও বিলাপিত বাতাস কেঁদে ওঠে তার স্তব্ধ কব‍রে
ফ্যাকাশে বিদ্যুতের নিচে এত এত ভীষণ সমাধি
বিভ্রান্ত মানুষেরা অবশ্যম্ভাবী দিক্ হারায় গভীর রাত্রে,
 
যেন সমতলভূমি জুড়ে ঘুরে চলেছে নির্জীব প্রেত
তাদের খুঁজে পেতে হবে জীবন ধাবিত মন্ত্রের কবচ।
 

 



আয়ন মিনেলেসকিউ। (I'on minu'lesku)
রাজধানী বুখারেস্টে একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। ম্যাসিডোনস্কির সূত্রপাত ঘটানো রোমানিয়ান Symbolist movement-কে মিনেলেসকিউ আরও প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর কবিতায় এক আশ্চর্য সত্যের খোঁজ লক্ষ করা যায়, যে সত্য দৈনন্দিন চর্যার পদে পদে এক আকস্মিক অতিচেতনার কথা বলে। ১৯৪৪ সালে বুখারেস্টে ৬৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
 


 
 
নীরব রাত্রি (Noapte linistita)
 
এখানে কিছু কিছু সুর আসে
কখনও উত্তাল তারা, কখনও নিঃশব্দ;
শ্রবণাতীত এত কলতান
দ্যাখো মানুষেরা শুনতে পায়নি-
অথচ অরণ্য আড়াল জুড়ে
যে পাখিরা লুকিয়েছে মানুষেরই ছায়া থেকে
শোনো সুসংহত চেতনায়
তারা প্রারব্ধ সকালের জন্য, নিরবধি গান গেয়ে যায়...
 

 
অন্তর্হাস্য (Zambeste)

 
হেসে ওঠো, যখন সবকিছুই কঠিন মনে হবে তোমার
মহাস্থবিরতায় শুনে নাও মানুষের পল্লবিত গুজব
তারপর আরও একবার মৃদু হেসে নাও...
যখন প্রেমের আড়ালে
নিপুণ অযত্নে কেউ ত্যাগ করে গেছে তোমায়
ভুলে যেও না আদতে সে অকৃতজ্ঞ, অহংকারী।
হেসে নাও;
আমাকে ধারণ করো দু'চোখের পাতায়
এখন আমি অতীতের চেয়ে তোমায় বেশি ভালোবাসি
এই দাবিতে বন্দি করি অনাগত আগামী
যদি তুমি এখনো ভালোবাসো আমায়
ধারণ করো বিপন্ন স্মৃতি-

ভুলো না, আমার সামান্য প্রেম একদিন স্পর্শ করেছিল তোমায়...

৩টি মন্তব্য:

  1. সাধারণত এতো বৃহৎ পরিসরে অনুবাদ কাজ সচারচর হয় না তদুপরি এতো নিষ্ঠা সহকারে অনুবাদ কখনো কখনো অনুসৃজন হয়ে উঠেছে... খুব খুব ভালো লাগলো

    উত্তরমুছুন
  2. মূল ভাষায় পড়িনি ,ভাষা জানা নেই বলে। অনুবাদ স্বয়ংসম্পুর্ণ কবিতা হয়ে উঠেছে।

    উত্তরমুছুন
  3. অনুবাদের জগতে একের পর এক দৃঢ় পদক্ষেপ তার জন্য ধন্যবাদ, কবি। তবে একে শুধুই অনুবাদ বলতে পারি না। কবির নিজস্বতার তীব্র বোধ একে স্বকীয় কবিতার রূপ দিয়েছে অবশ্যই মূল ধারণাকে অবিকৃত রেখে। পাঠকের মনে কবির এই সাবলীল গভীরতা ছুঁয়ে যাবে বারংবার সেটাই মনে করি।

    উত্তরমুছুন