অমিতাভ দাস-এর কবিতা
প্রণয়কুসুম বনে
প্রণয়কুসুম বনে বিচ্ছেদ ভুজঙ্গ রয়েছে সজনী...টপ্পা শুনতে শুনতে রাত নামছে আমলকি বনে । রামকুমারবাবু গাইছেন বিরহের পদাবলি । তোমার স্তনের মতো নরম চাঁদ এবং তার বিচ্ছুরিত জ্যোৎস্নায় দেখি ভুজঙ্গপ্রপাত...হুইস্কি তখন অত্যন্ত সংসারী । নির্লোভ মানুষের আনীল আনন্দ । হলুদ গড়িয়ে নামছে বরফ চুঁইয়ে । রাধিকা তখন সান্ধ - জলসায় । ফোন থেকে ঝরে যাচ্ছে তাঁর কণ্ঠস্বরের মসৃণ । অকুল এক কান্ডারী আছে , শ্যাম নাম , মন পীতবাসে দেওয়ার পর থেকেই এই সমূহ আকুলতা । তা তুমি কি লক্ষ্য করেছ ? -- এই বধিরতা প্রিয়। এই প্রণয়কুসুম , এই বিলাপ , এই আর্দ্র স্তনভার ...যত্নে গাঁথা মালা , বেঁচে থাকার অলৌকিক দাহ । একটা কোকিল ডেকেছিল একদিন তোমার গহন- বিজনে । একটা মাথুর পর্যায়ের রাগ বেজেছিল শুধু তোমার অসীমে ...
নৈঃশব্দ্যের দেবী
কোনো চুমুকেই তোমাকে আর মনে পড়ে না । তেরি সখি মোরে প্রিয়া ঘর আয়ে...লিখছি চুমুকের কথা ।লিখছি চুমু ।একখন্ড আগুন...মোরা প্রিয়া ঘর আয়ে...এই কাওয়ালির রাত থেকে ছিটকে যাচ্ছে শীতের চন্দন--স্কচের সোনালী লালায় তুমি প্রেম শ্যাম রসিয়া হয়ে মনমোহিত করছ ।জাদুপাখি । কদম্বকাননের বিভ্রম । কোনো চুমু নেই ।বিস্বাদ জড়িয়ে আসা জিভ থেকে ওই দ্যাখো সাপের হিস্ হিস্ ...বাঁশরি শুনত সব সখিয়া আয়ে...হাসছো হে নৈঃশব্দ্যের দেবী...হাসছো উন্মাদ কাঙাল । সব চুমুকে আমি ঠিক কাকে ,কাকে যে খুঁজে পাই--কাকে...কে জানে...মা পা ধা নি সা...হে জাগ্রত ভূত আর অপার নৈঃশব্দ্য পুরুষ...আলাপের পর থেমে গেল সিগারেট--ধোঁয়ার জাদুকর আর ঘুম...
শ্মশান
শ্মশানে এসে বসলাম । পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মাণী নদী । এখন জল শূন্য । একজন বললে , বর্ষাকালে বেশ জল হয় । তখন সন্ধ্যা হয় হয় । অটোঅলা ছেলেটিকে দাঁড়াতে বললাম ।গিয়ে বসলাম শ্মশানে । কাছেই সুন্দর কারুকার্য মন্ডিত তারামা মন্দির । খুব নির্জন-- প্রায় জনশূন্য । শুকনো পাতা ঝরে আছে । পা দিলে মচমচ শব্দে ভেঙে যায় । ঢুকেই গা ছমছম করে উঠল । শ্মশানের পাশ দিয়ে রাস্তা গ্রামের ভিতরে চলে গেছে । একটু দূরে অল্প বয়সি দুটি ছেলে আমাদের দেখে একটু অপ্রস্তুত হল মনে হয় । কিছুক্ষণ বসার পর দেখি একটি লোক হেঁটে আসছে এদিকেই । বললাম , এইটে কী নদী ? সে বললে , বমভণী । তা থেকে আমি বুঝলাম ব্রহ্মাণী । সে আপন মনে শ্মশানের দিকে চলে গেল । সন্ধ্যা হয়ে এলো । ঘরের ছেলে ঘরের দিকে চলো । উঠে এলাম ।ভিতরে ভিতরে নির্জন হয়ে আছি । চুপ হয়ে গেছে হৃদয়ের চলাচল ।
অবিদ্যাস্বরূপিনী
সে আমার মৃত্যু । অবিদ্যাস্বরূপিনী ।প্রেম , প্রেতবৎ । শৃঙ্গারমায়া -- মেহেদি হাসানের গজল যেন । বেদনার জমে থাকা দাগ । বললাম , যেদিন দেখা হবে , এত জোরে হাত চেপে ধরবো যে , কিছু বলতে পারবে না মাঝরাস্তায় । কলকাতার ভিড় রাস্তায় তোমাকে ছাড়া চলতে পারি না ।সে বললে , এইজন্যেই তোমায় ভালোবাসতে পারি না । দস্যু একটা , শয়তান লোক ।
এসব হজম করতে হয় প্রেতপুরুষের । অবিদ্যা থেকে বিদ্যা । মায়া থেকে মোহ । আমি থেকে তুমি । আর এই লালনের আরশিনগরের ভিতরে তার ছায়া , তার উদ্ভট লীলা । তার উন্নত পয়োধর , পীত শিহরণ । আজ যেমন বললে , পরজন্ম বলে কিছু হয় ? বললাম , জানিনা , তবে তথাগত বুদ্ধ এ প্রশ্নে নীরব থেকেছেন । এসো এ জন্মেই একটা দীপ্ত চুম্বন এঁকে দিই মৃত্যুর মতো অহং- শূন্য নীলে
পুরাতনী
ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে-- নিধুবাবু গাইছিলেন। তুমি বসে থাকলে বিজন আঁধারে একা । দূরে চৈত্র পবন। দূরে আমাদের ফেলে আসা যৌবনের মর্মরিত বিলাপ । ছোট ছোট গুঁটি ধরেছে আমগাছে । কাগজি লেবু হয়েছে বেশ কিছু । নিকোনে উঠোনে তোমার আলপনা দ্যাখে চাঁদ , প্রগাঢ় বিস্ময়ে । তুমি আমাদের খড়ের চালে উঠিয়ে দিয়েছ পুঁইচারা। ধান উঠেছে কৃষক - পাড়ায় । তুমি টপ্পা- ঠুমরিতে মেতে আছো খুব । বিস্মিত প্রেমিকার মতো আলতা পরেছ দুই পদ্মের মতো পায়ে । কত ফুলের উপচার তোমার পূজার থালায় । বেদপাঠ শেষে ফিরে এসে দেখি আমাদের ভাতের থালায় এসেছে প্রথম সর্ষে- ইলিশ , তোমার হাতের ছোঁয়া । তোমার বাগানে রাত জুড়ে জ্যোৎস্নার গান , আর গতজন্মের মাধবীলতা । তুমি ফুটে ছিলে । ফুটে আছো । ফুটে থাকবে আমাদের পল্লবিত দরিদ্র- উঠোনে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন