চন্দন ঘোষ-এর কবিতা

চন্দন ঘোষ-এর কবিতা


ইঁদুর দৌড় সমগ্র


কার্নিশ থেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে যে মানুষ,তার কাছে চাঁদ আসে অনেক রাত্তিরে। চাঁদের মাংসল স্তনে আঙুল ছোঁয়ালে ভেসে ওঠে অনেক পুরোনো এক নিখোঁজ জাহাজ। ডেক ভর্তি স্মৃতির কঙ্কাল। নড়ে চড়ে। এ ওকে আদর করে। বহুকাল এই রাত আদর জানত না। আজ এই জাহাজের বুকে ঝরে পড়ছে চাঁদের আদর। পায়ের নীচের হাওয়া চুপিচুপি ডাক দিয়ে যায়। চাঁদের শরীর ছেড়ে লোকটা কি লাফিয়ে পড়বে না? তার যে ঘুমের সঙ্গে কত কথা বাকি।


গায়ের চাদরটা ঝাড়তেই ঝপ করে ঝরে পড়ল মনীষার সেই হাসি। তারপর পুরোনো কয়েনের মতো  মেঝেতে সে গড়াচ্ছে তো গড়াচ্ছেই। কোথায় যে যাচ্ছে এই অসময়ে! পাহাড়ের পায়ের কাছে গোধূলিভর্তি সেই  পাইন কাঠের ছোট্ট দোতলাটার দিকে নাকি? ওই ঘরে শুয়ে আছে মনীশের অবান্তর স্মৃতির শরীর। আর বিশ্বাসঘাতের কিছু ছোটোমোটো ছুরিকাঁচি, পিন ও পেরেক।

কিন্তু এদিকে এ কী! গায়ের চাদরটায় অচানক এত  রক্তারক্তি হল কী করে!

 

রোজকার খেলার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে একটা মিথ্যের সাপ। জমকালো, পাঁচ পা-ওয়ালা, সত্যির থেকে পাঁচ গুণ ঝকমকে। সে বড়ো ইশারাপ্রবণ। কাবার্ডের নিচ থেকে  উঁকি দিচ্ছে তার প্রেম। সত্যি প্রেম, মিথ্যে প্রেম, জোকারের মুখের মতো রঙচঙে প্রেম।   মিথ্যে শিখেছে সে খুব। চোখ থেকে জল চুরি করে হাতসাফাইএ ভ্যানিশ করে দিতে চায়।

রোজকার খেলার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে একটা আর্তনাদ। খোলস ছাড়ার আর্তনাদ। লেজ থেকে নিজেকেই গিলে ফেলার চিৎকার।

 রোজ রোজ মিথ্যের জিভ দিয়ে সত্যিকে ভক্ষণ করার চিৎকার। নিজেকে তো গিলেই ফেলেছে। তার আর কোনো কান্না নেই। শুধু এক আর্তনাদের খোলস বাইরে বালিতে পড়ে আছে ।

 

এ পৃথিবী ছোটো পড়ে গ্যাছে আমার। রাত্তিরে শুতে গেলে পা বেরিয়ে থাকে। এ আকাশ ছোটো পড়ে গ্যাছে আমার। মাথা ঢাকতে চাইলে পা বেরিয়ে পড়ে। এ শরীর আঁট হয়ে গ্যাছে আমার, হৃদয় বেরিয়ে পড়েছে পা হয়ে। পা, ওরে পা তোর আর কী দোষ, সমস্ত রাস্তাই তো তোর কাছে ছোটো পড়ে গ্যাছে। তবুও মোকাম আর কোনোদিকে দেখাই যাচ্ছে না।

 

এই যে এখন কেউ তোমাকে ডাকছে না, এটা মানিয়ে নিতে শেখ। এই যে তোমাকে দোলমঞ্চের এক কোনায়ও দাঁড়াতে জায়গা দিচ্ছে না, এরও একটা মানে আছে। মানে, হয়ত সহজে তুমি পোষ মানতে চাইছ না, হয়ত "কৃষ্ণ বল, সঙ্গে চল" বুলি শিখতে চাইছ না। বেয়াড়া রকমের বর্বর তুমি। তবে শাপে তো বরও হয়। # তুমি হয়ত এবার গভীর একটা গুহায় ঢুকে পড়বে। তারপর তোমার চারপাশে একটা খোলস গজিয়ে উঠবে। সেখানে অনেকদিন কাটবে, অনেক, অনেকদিন। চারপাশে অনেক অনেক রেশম সুতো, অনেক রঙ, অনেক ছবি, অনেক সুর, গন্ধ। তারপর একদিন আলোর মতো পাখা খুলে বেরিয়ে আসবে তুমি। অতঃপর উড়ান আর উড়ান। কীর্তনের অনেক উপর দিয়ে, মেডেলের পাশ কাটিয়ে, তর্জাগানকে পিছনে ফেলে উড়ছ, তুমি উড়ছ। আর আকাশ টুকি দিয়ে ডাকছে তোমাকে।

 

সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারের বাইরে বসলে নিজেকে মনোরোগী মনে হতে থাকে। চারপাশের সবার ভেতরটা বেশ পরিষ্কার দেখতে পাই। ভেতরে ধু ধু সব মাঠ। ঘাস নেই। একটাও গাছপালা নেই। একটুও ছায়া নেই জিরোবার। শুধু কাঁটা গাছ। একটা পাগল পাগল হাওয়া বইছে। ধুলোঝড় উঠেছে। উড়ে যাচ্ছে বালি। ভেতরে এতটা ঝড় নিয়ে ওরা হাসছে কী করে! ওদের নাক দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে না কেন? ওদের মাথার ভেতরে কী একটা আস্ত অভিনয় শিক্ষার স্কুল চলছে যার ছুটির ঘণ্টা পড়ে না কখনও। #   সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারের বাইরে দিগন্ত অব্দি ছড়িয়ে আছে একটা পাগলাগারদ।  আর ভিতরে কী প্রাণের আরাম। সিরিয়াল নম্বর শেষ হয়ে গেছে।এখন কেউ আর মনোরোগী নেই।

 

একটা মাতালের পিছনে আরেকটা মাতাল দৌড়চ্ছে। তার পেছনে আর একটা, এবং আরো, আরো, অনেক অনেক মাতাল। তাদের মুখে কী নিষ্পাপ হাসি কারণ তারা কেউ জানে না যে তারা নিশ্চিতভাবে মাতাল । তারা দৌড়চ্ছে কিন্তু কেউ কাউকে ছুঁতেই পারছে না। দূরে দূরে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যের ফুচকা বিক্রি হচ্ছে। এরা কি এইসব ফুচকার দোকানের জন্যেই দৌড়চ্ছে? ফুচকাওয়ালাদের চোখেমুখে কী যে চমৎকার একটা রহস্য খেলে যাচ্ছে!ভাবা যায় না।

কিন্তু ওরা কি জানে, এত এঁকেবেঁকে দৌড়লে শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কোথাও পৌঁছনো যায় না।

 

বসন্ত কাবিনে কোনো ইঁদুর দৌড় নাই। শুধু  নির্জন কুণ্ডলী পাকানো কিছু ধুঁয়া। আর অনিশ্চিত  নৈঃশব্দের ঢেউ। সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে শূন্যতার অহিফেম চাষ হয়। রাণাবাবু সেখানে শূন্যতার কাঠকুটো জড়ো করেন। আর গৌতমবাবু সাররিয়াল মশালে উহাতে অগ্নিসংযোগ করেন। চমৎকার তিমিরবিদারী এক ধূনি প্রজ্জ্বলিত হয়। অন্ধকারগুলি হাইড্র‍্যান্টের ঝাঁঝরি বাহিয়া নিচে পলায়মান। মরে না তবু একেবারে। ধূমায়িত হয়। তারপর অজস্র ইঁদুর, অন্ধ তারা, টুকরো টুকরো অন্ধকার ওষ্ঠে ধারণ করিয়া কলকাতা শহরে শুধু দাপাদাপি করে। বমি করে। কফি হাউসে, খালাসীটোলায়। কবিতার মতো কিছু থকথকে আঠালো মৃত্যুর নির্যাস। কলেজ স্ট্রীটের কালো পিচে রাত্রি হয়ে ডানা মেলে তারা।


তুমি জানতেও পারছ না মেঘের আড়াল থেকে সারাক্ষণ সে লক্ষ করছে তোমাকে। রোববার সন্ধেবেলা কার আঁচলের তলে কাটাও আর বেস্পতিবার কোন থানে ফুল চড়াও সে সব তার নোটবুকে লেখা হয়ে যায়। এই যে বিকেলের আলো এসে লাল চুল ছড়িয়ে বসে আছে এর মধ্যেও তার চোখদুটো এসে তোমাকেই খোঁজে। কাউকে এমন ভালোবাসা ভালো না। কাউকে এমন ভুল বোঝা--না, তাও ভালো না। ভীড়ের মধ্যে আজ যদি কোনো বাতাস তোমার কাঁধ ছুঁয়ে দেয় জেনো সে তারই দীর্ঘশ্বাস।

নজরে রাখছে, সে নজরে রাখছে তোমাকে। পালাতে পারবে না। লুকিয়ে পড়তে পারবে না কোনো ভীড়ে। এমন সে নজর যেন মৃত্যুও ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না তোমাকে কোনোদিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন