বধির
মৌমিতা পাল
১.
চতুর শবর, ছিলি, থাক। অধরা খুঁজেছে স্মৃতির অবাধ্য ঠোঁট...
ইথারে ইথারে জটিল গুল্মের ছায়া। নিচু হয়ে আড়াআড়ি অদৃশ্যতার কিনারা খুঁজছিলাম।যুবতী কিছু জানে না ভেবে নিয়ে ক্ষমা করছিলাম ভুলতর গলিকে। মাঝে মাঝে আমারও ভুল হয়। কড়িকাঠ থেকে ঝুলে পড়া মাকড়সার জাল তখন পুরোনো টুকরো কাপড় দিয়ে মুছি। অন্তরাত্মা উদ্ভিদ হয়ে শুষে নিতে চায় অন্যের অসুখ। ভুলে যাই শরীরে শরীরে ধান মেপেছিল কর্কটক্রান্তি রেখা। ভুলে যাই অস্থায়ী আয়ুর ভীড়। সবাই ভুল বলছে এমনটা মনে করে মনোহীনতার গন্ধে ডুবে যাই। তারপর আর কীই বাকি থাকে! কাশফুলের শারদবেলাতে অপরাধ অপরাধ খেলতে খেলতে শরীর ভরে ঢেলে দিই প্রবণতা। সামনে সেলাইয়ের ফোঁড় আর পেছনের রাস্তা বন্ধ।
আমিই মৃত্যু অথবা আমিই শস্যভূমি। রেলিংয়ে শুকোতে দেওয়া শাড়ি কেমন যেন ছবির মতো মনে হয়। হয়তো আমি সবার চেয়ে কম বুঝি , বহু দেখি বলে।
সকলেই ভুল বলে ভাবে ঠিক বলছে , আমি তাই কারো কথা শুনিনা , শোনবার ভাণ করি মাত্র। জীবনের কথা শুনি। জীবনের মতো সার কথা সোজাভাবে আর কেউ বলে না।
টিলার ওপর বাড়ি , মনের বসত কবে গেছে ছাড়ি ...
২.
অভিভূত হও , প্রতিভার মরাডালে মাটির আঙুল। সন্ন্যাসী চুল্লি জ্বালায় আর প্রশ্ন করে - 'এখানেই ছিলে তুমি ?' আমার শরীর নেই , আত্মারা ডুবে গেছে ঘাসে। প্রেতসন্তানকে কোলে নিয়ে বসে পাখার বাতাস করি। সন্ন্যাসী ফের বলে - 'এখানেই ছিলে তুমি !' কলের মতো জবাব দিই , বটের গোঁড়া খুঁড়তে শালবন খরচ করে ফেলি। মনে পড়ে যায় সাত বছরের সংসার , পাঁচতলা বাড়ির প্রতিটা ইঁটের পেছনকার পরিশ্রম। পুরাতন স্বামীর কলার ধরে জানতে চাই শ্রমের দাম। চাইলেও জেনে ওঠাটুকু ঘটে ওঠে না। 'তোমার সন্তান তোমার শ্রমের দাম বুঝবে' - কানে রিনরিন করে কোন অতীত বলে ওঠে। সন্তানরা বোঝে ! হয়ত ! কোন কোন জন গর্বিত স্বরে মায়ের শ্রমের মূল্যে ফুল সাজিয়ে দেয় , আমার মনে হলকা আগুন ওঠে। খাক হতে হতে বুঝি আমার কোলে প্রেতসন্তান। ও মুখে সাত চড়েও রা কাড়ে না। মৃত্যুর চেয়েও ছোট হয়ে বেঁচে আছি বহু বহু দিন। গোটা জীবনটাই বড়ো অপব্যয় করেছি শ্রমের , সময়ের , ভালোবাসার । যারা সাধক তারা তাই করে , ওরা সংসার করে না। সংসার ওদের রাখে না বলেই।
চেতনা বধির হলে আগুন ভেসে ওঠে। পারলে একটু পাখার বাতাস দিও। শান্তিকে কেমন যেন ঘুমের ভেতর হারিয়ে ফেলেছে ওরা। একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মাথায় - কেউ কি ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে ... কেউ ... কি ...ধাক্কা...
এই যে আমি রেষারেষি ছেড়ে এসেছি , তা কত জন্ম হল ভুলে গেছি। আফিমঘোরের মৃত্যু , ফাঁস লাগিয়ে হত্যা - এক জীবনে সব জীবনের মৃত্যুই টুকরো টুকরো হয়ে বেঁচে থাকে। সব স্মৃতি জ্যান্ত হলে 'হা ভগবান' বলে হাহাকার করতে হতো না। প্রেমিক ছুটে আসবে হাওয়ার মতো , আর প্রেতিনীর দুপাশে মহুয়াবাগান। চুল্লির ঘুমের আগে প্রেম নয় , কাম নয় , কান্না ঘিরে ধরে।
কার অনিচ্ছার ধাক্কা খেতে খেতে সকলে চুল্লির দিকে চলেছি !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন