কুমারেশ তেওয়ারী-এর কবিতা

কুমারেশ তেওয়ারী-এর কবিতা



বাগান
 

ক্যামেরা চালু করতেই হাত নাড়তে নাড়তে
দূরে সরে যায় ফুলের বাগান
গাছপালা ফুল ফল দরোজা জানালা নিয়ে
সরে যায় শুদ্ধমতি অরণ্যের দিকে
জুম করেও ধরা যায় না আর, কিছুতেই তাকে
 
অরণ্যের কোলে যে বাতাস তাকে
মধুবাতা নাম দিলে কী খুশি কী খুশী
সনাতন বাঁশি মুখে ফুঁয়ের প্লাবন
 
ক্যামেরা নাছোড় দৌড়ে যায় পিছন পিছন—
সোনামন একটা ছবি শুধু, স্ন্যাপসট
 
বাগান কী দেখে? হাত, হাতের ভেতরে আড়মোড়া ভাঙে বাঘ ঘোলাটে চোখের
 
দেখে আর সরে যায় সোমত্ত বাগান
পায়ের চাকায় তার ধ্রুপদ, লাগিয়ে নেয় পিচ্ছিলতা
এই দৃশ্য দেখে গাছেরাও হাসে খুব
ময়ূরীও পাক খেয়ে বসে পড়ে ডালে
বসে বসে দেখে তার অদৃশ্য ছায়ার থেকে নিজস্ব ময়ূর
শিখে নেয় নাচের মুদ্রাটি, পেখমে রোদের আতুপুতু
ক্যামেরার লেন্সে এসে পড়ে কালপুরুষের থুতু




মালা

 
স্বপ্ন দেখা শেষ হলে ফিরে আসি ঘরে
ঘরটি আকারে ছোটো চেতনাদেয়াল ঘেরা
এক শিশু সেই কবে থেকে অনন্ত নিদ্রাই
চোখের ভেতরে তার জেলে এক
জাল ফেলে মাছ ধরে কতকাল ধরে
মাছগুলি স্থলে উঠেই অদ্ভুত ভঙ্গিমায় নাচানাচি করে
তাদের শরীর থেকে ছিটকে ছিটকে পড়ে
পাঁচে পঞ্চবাণ
শিশুটি বাণের মুখে পরিয়ে পরিয়ে দেয়
ঘোড়াদের নাল কেশরের ঝালা
বাণগুলি ছুটে যেতে থাকে আলোেঘেরা এক দেবালয়ের দিকে
বিগ্রহ মূর্তিটি তখন হয়তো সবে খুলেছে চোখ
তার কাছে সারি সারি শুয়ে পড়ে বাণগুলি
তিনিও তাদের মুখে পরিয়ে দিতে থাকেন
ছ‘টি রিপু দিয়ে তৈরি সুদর্শন মালা



ঈভ ও কীট বিষয়ক কবিতা
 

ছুরি দিয়ে কেটে আপেলে সাজাচ্ছো ফুল
চমকে উঠছে ঈভ এবং মল্লার
উচ্চাঙ্গসংগীতের ভেতরে কেঁপে উঠছে আলাপ
 
বলছো, ফুল তো ভালো, ঘনিভূত জল ধরে রাখে
জলের ভেতরে মধু মৌপোকাদের গুঞ্জন
পরমার্থ ও সুখবিলাস মিলেমিশে একাকার
নয়নাভিরাম বলে ডাক দিলে
ফুলও দুলিয়ে দেয় প্রণয় চামর
আকাশের গর্ভগৃহে বেজে ওঠে সমুদ্র সিম্ফনি
 
তবে কেন নৌকার ভেতরে শুয়ে চমকে ওঠে ঈভ?
থরথর বাহুলতা, ভুরু ঘিরে স্বেদ বিন্দু জমে?
 
ফুলের ভেতরে থাকে কীট, দংশনবিলাস
দর্শনে ঈভের ওঠে বড়ো নাভিশ্বাস



বাতি নিভে গেলে
 
বাতি নিভে গেল, বলতেই জ্বলে ওঠে বাতি
তবে কি ভ্রমের কলা ধীরে ধীরে উঠেছে বেড়ে চোখে!
বুঝতেও পারিনি, কীভাবে ঝোলানো ব্যাগের থেকে
অন্ধ সাপ এসে দংশন রেখে গেছে কপালে আমার
এসময় গাছেরা কি হেসেছিল? চন্দ্রকলা
বামন অবতারের কথা ভেবেছিল?
 
তবে বাতি সত্যিই যদি নিভেই যায়
যদি অন্ধিসন্ধি ক্যালেণ্ডার থেকে মুছে ফেলতে চায় তারিখ
তবে ‘দোষ কারো নয় গো মা’
 
গামছার খুঁট থেকে হঠাৎ লাফিয়ে নেমে স্নান
যদি নিয়ে যায় পুকুরের দিকে
পৃথিবীর তাবৎ কলঘরগুলিতে তালা দিয়ে
আমি সখাৎশলীলে, না না কেবল অবগাহন নয়
সুগন্ধ জলের গর্ভে ডুব স্নান নেবো শিক্ষার্থীর



বৃষ্টিপতনের শব্দ
 

সারারাত ধরে বৃষ্টি পড়ার যে শব্দ
তার সঙ্গে অন্য মিল নেই জাগতিক যে কোনো শব্দের
জল পতনের শব্দ তো খুবই পরমার্থিক
 
যে কোনো জলাশয়ের কাছে যাও
তোমাকে শুনিয়ে দেবে বৃষ্টিপতনের বিবিধ কিংবদন্তী কথা
যেমন ঘোড়ারা বৃষ্টির ভেতরে নেমে যখন তাদের নৃত্য রাখে
তাদের শরীর থেকে পিছলে পিছলে নেমে আসে
ছান্দ্যোগ্য উপনিষদ, আর রামকৃষ্ণ কথামৃত
 
আবার ওইসব জলাশয়েরাই তোমাকে শোনাবে
কোনো এক কবুতরের কথাও
ডানা ভিজে গিয়ে যখন সে উড়ালরোহিত
বাদামী বেড়াল পা টিপে পা টিপে শিকারী ভঙ্গিমা
 
চোখের ভেতরে তার যেই দেখে ব্রহ্মের স্বরূপ
বেড়ালের দুইচোখে ভেসে ওঠে অনন্ত পূর্ণিমা



অতলান্তিক

 

সাঁতার কাটতে কাটতে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি যখন
নৌকো নিয়ে ভেসে পড়লো পরাগবাহী মন
 
মন ভেসে যেতে যেতে দেখে
নদী ঘাটে জ্যোৎস্নার রস পান করতে নেমেছে
সাদা কালো কয়েকটি ঘোড়া
খরখরে জিভ দিয়ে চেটে খায় রস
কী আশ্চর্য সকলেই অন্ধ তারা
তবু কী নির্ভুল রসের সন্ধানী!
 
রস পান শেষ হলে শনশন উড়ে যায়
ঘোড়াদের দল
মন ভাবে, এ কেমন ভেলকি পুরাণ!
অন্ধের চোখের তারা কোন ধর্মে আলোকসমান!
ভাবতে ভাবতে দেখে মোমবাতি জ্বলে ওঠে সংগীতপ্রবল

মোমের সমুদ্রে ভাসে অতলান্ত জল


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন