মিঠুন চক্রবর্তী'র কবিতা

মিঠুন চক্রবর্তী'র কবিতা
 
 
 
একটি বর্ষামঙ্গলের জন্য


শূন্যে উড়ছে বিগতজন্মের প্রেমিকাদের হাতে বোনা
পশম উত্তাপ। হাত বাড়াই...
এই আমার হৃদয়রেখায় বালি রঙের দীর্ঘ উপত্যকা,
পাশে ভাঙা নৌকাবৎ আজীবন পড়ে থাকা কালো তিল,
গত কয়েকজন্ম ধরে একবুক বর্ষা পেরিয়ে এসে
আজ দাঁড়িয়েছি যেন এক অমোঘ দহন দুপুরে।
পেটে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে সম্প্রতি এক রহস্যময়ী
জানালার বামপাশ থেকে ডানপাশে চলে যায়,
শুকনো নাশপাতি গাছে কাটা ঘুড়ির ল্যাজের মত ঝুলে থাকে পথ
 
এই দীর্ঘ নিরুত্তাপ চলা, মদের পেয়ালায় জমে ওঠা ধুলো,
খসে পড়া ইঁটে ইঁটে ফুটে ওঠা স্মৃতির কোলাজ,
পূর্বপুরুষের ফেলে রেখে যাওয়া, হে আদিম অক্ষর !
একটি বর্ষামঙ্গল লিখবার জন্য আমি রোজ বাষ্প হয়ে যাই

 
তোমার অস্তিত্বের নীলকালি


তোমার অস্তিত্বের নীলকালি উলটে না দিলে
এই যে চাঁদ ওঠা, তেমন কিছুই নয়
দৈনন্দিন প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র
 
পেরোতে হবে বলেই
সাদা-কালো জেব্রাক্রসিং ধরে পারাপার,
উদাসীন টানে ফুরিয়ে আসা সিগারেট -
আলতো টোকায় উড়িয়ে দেওয়া ছাই রঙের গ্রাফ
 
তোমার অস্তিত্বের নীলকালি উলটে না দিলে
জীবন আর কিছুই নয়, তীব্র বিষাদ...

 
স্মৃতি


ঘর নেই, পাশাপাশি মাথাউঁচু ইটের দেয়াল
প্রতিটি একাকী শ্বাস
অরণ্য মাড়িয়ে যেন চলে যায় দীর্ঘ শীতকাল
 
চাঁদ নেই, চাঁদোয়ায় পরিপাটি ডানা
ভেতরে বিষণ্ণ দ্বীপ, ছাদে দীপাবলি
 
তবু, এসো, দেখে যেও
ভীষণ কুয়াশা চিরে উঠোনের মাঝে
এখনো দাঁড়িয়ে আছে পাখির কূজন জানা গাছ



বিজ্ঞাপনে দাঁড়িয়ে আছো চাঁদ


বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞাপনে দাঁড়িয়ে আছো চাঁদ
সেতুর নীচে জন্মান্ধ স্রোত,
নাবিকহীন নৌকার মতো চোখ, সহজ ডাকে
ভাসিয়ে নিয়েছো রাতের রুপোলি শহরে
 
অনেকদূর গাঁয়ে যে অমাবস্যা রঙ লোকটি
মাঠের থেকে উঠে আসছে
আমরা ক'জন তাঁর জোনাকি সন্তান
তাঁকে বাবা ডাকতে ডাকতে ঝুলে পড়ছি কাঁধে
 
তিনি তাঁর দু'হাতের তালু মেলে ধরে
আমাদের শস্যের কবিতা পড়াচ্ছেন
 
আমরা শিখছি,
বিজ্ঞাপন নয় বিজ্ঞানে ভরে যায় মুঠো


 
গোলাপমুদ্রা


বয়স বাড়লে প্রেম পাহাড়ি-তরুণ,
মাথায় ঝাঁকড়া চুল -
                               বরষার মেঘ ;
খরস্রোতা নদীতে আকণ্ঠ নেমে স্নান করে
 
চার হাত দূরে ঠিক মধ্যদুপুর এলে
অলস জানালা দিয়ে ধোঁয়াশার দিকে
হেঁটে গেল হিলহিলে ময়াল শরীর...
ঘনকাচ চশমায় তরল সবুজ ছাড়া
সেই সব দৃশ্য কবে অন্তর্ভুক্ত বিষয় হয়েছে !
 
কী কী ছিল, কী কী গ্যাছে !
আঙুলের প্রান্তভাগে বিগত ঘামের দাগ,
গোলাপের মুদ্রা জানা দু'টো করতল জানে
ভালো রাখা ছাড়া আর সবকিছু পাপ


 
ঠিকানা


আদপে মানুষের কোনও ঠিকানা নেই-
যেমনটা থাকে বৃক্ষের।
 
তবুও পিপাসার্ত শিকড় বাড়াই-
সূর্যের দিকে,
বৃষ্টির দিকে,
ভালবাসার দিকে....
 
দরজায় টাঙিয়ে রাখি কমলা রঙের
লেটার বক্স,
আর প্রিয়- মুখ থেকে উড়ে আসা
চোখের অক্ষর।
 
অথচ মানুষের কোনও সঠিক ঠিকানা নেই,
টেলিফোনে কত সহজে বদলে যায়-
প্রিয় নম্বর, প্রিয় কণ্ঠস্বর
 
তবুও শিকড় বাড়াই,
তবুও কোন বৃষ্টি বড় আপন মনে হয়,
তবুও হঠাৎ ভাল লাগে এক বিকেলের আলো,
 
তবুও লেটার বক্সে জমে ওঠে
একটা একটা দীর্ঘ  অপেক্ষার রোদ্দুর....
 
শেষে নির্বাসনে পা সরে গেলে
শিখে যাই মানুষ আসলে ভাসমান দ্বীপ
বুকপকেটে যত্নে ভাঁজ করে রাখা ঠিকানা
আসলে ভুল করে চাওয়া মানচিত্র।
 
রাতের আকাশে সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের মত
তারারা লিখে রাখে-
হাতে হাত ছুঁয়ে সরে যাওয়া অসহায় প্রাচীন ব্যথা।

 
 
সহজতম

 
বহুদিন মাথা তুলে আকাশ দেখি না,
বহুদিন চাঁদের কল্পনা এঁকে কবিতা লিখি না
 
যে তল্লাটে নতুন এসেছি, তার একা ছাদে সন্ধ্যা,
বসে থাকি চুপ....
দিগন্তে লুকানো ঘর ভেসে ওঠে নক্ষত্রের মতো
 
বৃত্তাকার ভাতগন্ধে নুন, ঝাল, নিমপাতা ভাজা....
কঠিন-কোমল হাত গুনে নেয় ঘামে ভেজা চুমু
 
জানি না, চিনি না, তবু,
ধুলো থেকে উড়ে আসে নানা রঙে পরিচিত কথা
 
কিছু কি সহজ নয়? প্রশ্ন রাখে অনুর্বর মাটি ,
উত্তরে লিখেছি , চাষ , সম্পর্কের বীজে


 
অসুখ


মাঝেমধ্যে মাথার পাশে এসে বসুক অসুখ,
নীলচে মতন ঠোঁট, শ্যাওলা রঙের চাহনি।
ছেলেবেলার দস্যিপনা দুপুরে ঠিক যেভাবে
মায়ের ডাকে ঘরে ফিরে
বসে থাকতাম তালপাখার শীতল বৃত্তে ।
 
অসুখ এসে বিছানায় বসলে,
সারা ঘরে দাপিয়ে বেড়ায় মেঘ, টানা বৃষ্টি...
আর হঠাৎ করেই ভীষণ জোরে বজ্রের শব্দ হলে,
তুমি তৎক্ষণাৎ বিশল্যকরণী লতার মতো
জড়িয়ে ধরো আমাকে
 
আমি দু'হাতে তোমার চিবুক তুলে বলি,
' ভয় নেই, আছি তো আমি...'
 
 

যে ভালোবেসেছে

 
ভাবনা জুড়ে স্পর্শ তোমার, আকাশ জুড়ে পথ....
ভালোবাসার কাছেই আছে মনে রাখার শপথ
 
মনের ভেতর সোনালি মাছ, বুকের ভেতর সুখ,
দখিন হাওয়ায় আলোর পালক এমনি করেই ভাসুক
 
এমনি করেই দিন কেটে যাক, এমনি করেই রাত
ঝিনুক-মহল সাজিয়ে রাখুক মুক্তো লেখা হাত
 
হাত ঘুরিয়ে বৃষ্টি নামাও.... হাত ঘুরিয়ে রোদ....
ভালোবাসা মানেই যেন আগুন পেল বারুদ
 
আগুন দেখে উৎসাহীরা দেখতে এলে ছাই
দেখিয়ে দেবো পলাশ বনে ফুটেছে রোশনাই
 
 

অপাঠ্য

 
যখনই শহরে যাই, মনে পড়ে পলিদির কথা।
আগে গ্রাম ছিল।
বেখাপ্পা সারল্য সরিয়ে বুকের ঢালু পথে
আজও থেকে গেছে বহমান নদীটি ।
 
বিকেলের লঞ্চে বাড়ি ফিরি,
চলমান দূরে মানুষের টুকরো টুকরো তৈলচিত্রে
ক্রমশ কালো কালো ছোপ পড়ে আসে....
 
ভাবি, পলিদির সাথে শেষ কবে দেখা... মনে নেই
অজস্র কর্মব্যস্ততার মাঝে একা একলা নদীটিতে

সন্ধের আগে অপাঠ্য লাল লাল ঢেউ ওঠে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন