মহাপঞ্চমীর গল্প

ছায়াবর্ত 

রূপায়ণ ঘোষ 

র্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁঁড়ালো সুকমল। কাঁধের অফিস ব্যাগটা বাঁ-হাতে চেপে ধরে অসহিষ্ণুভাবে কলিংবেল টিপল কয়েকবার। জামা-প্যান্টসহ সমস্ত শরীরটা ঘামে ভিজে জবজব করছে,  রুমালে ঘন ঘন মুখ মুছে চলেছিল সে। শহরতলি অঞ্চল- রাত্রি সাতটা-আটটার মধ্যেই শুনশান হয়ে যায় চারদিক; সেখানে আজ সাড়ে ন'টা! রাস্তার আবছা আলোয় দেখে মনে হয় বাড়িগুলো যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। এখানে-ওখানে দু-চারটে কুকুর কেবল তারস্বরে ঝগড়া করছে। সুকমল চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে এছাড়া আর কারোর উপস্থিতি টের পেল না। 

কিন্তু সুপর্ণা এখনও দরজা খুলছে না কেন? ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে আবারও কলিংবেলে হাত রাখল। কয়েকটা মুহূর্তমাত্র, দরজা খুলে গেল। ঘুমচোখে সুপর্ণা প্রশ্ন করল,  "আজ এত দেরি হল যে?" 

দ্রুতপদে বাড়ির ভিতরে ঢুকে সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজাটা বন্ধ করল সুকমল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "জল"। 

স্ত্রীর হাত থেকে ঠাণ্ডা জলের গ্লাসটা তুলে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলল; তারপর ধীরে ধীরে ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে নিঃশব্দে পড়ে রইল অনেক্ষণ। 

 

এভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল সুকমলের মনে নেই, ঘুম ভাঙলো মাঝরাতে ব্যালকনির দিক থেকে আসা ঠাণ্ডা জলো হাওয়ায়। একটু দেরিতে হলেও অবশেষে বর্ষা এসে পড়েছে, হয়তো থাকবেও বেশ কিছুদিন। আস্তে আস্তে সোফা থেকে নামল সে, ঘড়ির দিকে তাকালো- রাত্রি আড়াইটে। ঘরের সমস্ত আলোই মোটামুটি নেভানো; সুপর্ণা বোধহয় শোয়ার ঘরে। ক্লান্ত স্বামীকে টেনে তোলাটা তার ঠিক মনে হয়নি হয়তো। সুকমল শ্লথ পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো, থেমে থেমে অনেক ভাবার পর সিগারেট ধরালো একটা। দু-তিনটে লম্বা টানের পরে ধোঁঁয়া ছাড়ল সে, নিকষ কালো অন্ধকারে ধূসরবর্ণ ধোঁঁয়া মেঘের মতো এলোপাথারি ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে গেল একসময়। তখনই ভেসে উঠল দৃশ্যটা; জনশূন্য রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের ধারে তিন-চারজন ছেলে খুব মসৃণভাবে ক্ষুর চালিয়ে দিল লোকটার গলায়! রক্তাক্ত দেহটা কাটা মাছের মতো ছটফট করতে করতে স্তব্ধ হয়ে গেল কিছু পরে। মুখে হাত চাপা দিয়ে সে দৃশ্যে শিউরে উঠেছিল সুকমল। আবার মনে পড়তেই হাতটা কেঁপে উঠল তাঁঁর, আধ-খাওয়া সিগারেট ছিটকে পড়ল মেঝেতে। অকস্মাৎ তখনই একটা ছোট্ট ইঁঁদুর নিমেষের মধ্যে ঘরের আলমারির কোণে লুকিয়ে পড়ল। সাথে সাথে দ্রুত পায়ে বাড়ির দরজা ঠেলে নিজের ভিতরে ঢোকার দৃশ্যটা সেকেণ্ডের ভগ্নাংশে এসেই চলে গেল যেন! খুব ধীরে অন্তহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুকমল। 

                                            

দিন সাতেক কাটতে না কাটতেই কাগজে খবরটা দেখে সুকমল চমকে উঠেছিল। বৈদ্যবাটি রেল স্টেশনের কাছে জনৈক পৌঢ়ের খুন হওয়ার পর থেকেই অপরাধীরা ফেরার ছিল, গত পরশু কলকাতার কোনও ঘুপচি এলাকা থেকে পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে বলে দাবি। 

খবরটা পড়ার পর একটা অদ্ভুত প্রশান্তি সারা শরীরে ছেয়ে গেল। বেশ কয়েকদিন পর মন দিয়ে অফিসে পড়ে থাকা ফাইলগুলো শেষ করল। কলিগদের সঙ্গে আড্ডা মারল জমিয়ে। শেষ বিকেলে সুকমল যখন রাস্তায় পা দিল- গোটা কলকাতা শহরটাই যেন বাড়ির দিকে ছুটছে। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ত মানুষের এই বিপুল স্রোতকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে লক্ষ করে সে। কারও উৎকণ্ঠিত মুখ, কারোর পায়ের দ্রুততা, চলন্ত বাস-ট্রেনে বারংবার কারোর ঘড়ি দেখে যাওয়া- সমস্ত কিছুর মধ্যে সুকমল যেন প্রাণ খুঁজে পাচ্ছিল। সুদীর্ঘ অরণ্যের ভিতর থেকে স্থানান্তরে ছুটে যাওয়া হরিণ যেমন গোধূলিকীর্ণ পথ চিনে চিনে ফিরে আসে হরিণীর কাছে... 

ট্রেনেই পার্সটা খুলল সে, তারপর নির্নিমেষ চেয়ে রইল সুপর্ণার ছবির দিকে। 

                                 

দীর্ঘদিন পর ঘরের আলো-আঁধারিতে দুটি শরীরে যেন ঝড় উঠেছিল। পরস্পরের মধ্যে ডুবতে থাকা রমণীয় ছায়া দুটি অপূর্ব শৈল্পিক ভঙ্গিতে ভাসিয়ে দিচ্ছিল এই পিচ্ছিল অন্ধকার। নারীর শীৎকার সুগন্ধে সিক্ত হতে থাকা মেঘ চূড়ান্ত গমন শেষে হালকা হতে হতে ক্রমে ঝরতে থাকলো প্রবল ধারায়। প্রিয় পুরুষের দেহটা আঁকড়ে ধরে সুপর্ণা চোখ বন্ধ করল। বহুদিন পর এই ঝড় তাকে তৃপ্ত করেছে। খুব জোরে শ্বাস নিল সে-  সুকমলের মর্মভেদী এই পুরুষালি ঘাম তার বড় পছন্দের। 

                           

শেষ রাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। টর্চ জ্বালিয়ে ঘড়িতে চোখ রাখল সুকমল- রাত্রি প্রায় তিনটে। বুকের কাছ থেকে সুপর্ণার মাথাটা আলতোভাবে সরিয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামল সে। গলাটা শুকিয়ে গেছে, বসার ঘরে পৌঁছে বোতল থেকে জল খেল কয়েক ঢোক। ব্যালকনির দিক থেকে একটা মিঠে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। একটা পাতলা জামা গায়ে গলিয়ে মন্থর পায়ে সুকমল ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। একটু আগে ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে, পিচ রাস্তাগুলো চকচক করছে যেন। নীচ থেকে উঠে আসা কাগজফুল গাছটায় হাত রাখতেই কিছুটা জল ছিটিয়ে পড়ল এদিক-ওদিক। একটা সিগারেট ধরিয়ে দিতে নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে গাছটার দিকে তাকিয়েছিল সুকমল। এভাবেই সেও একদিন সমাজের খুব দরিদ্র জায়গা থেকে একটু একটু করে উপরে উঠে এসেছে; পরিশ্রম আর সততার সাথে আপোষ করেনি কখনও- তাই আজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। গাছটার মতো তার শিকড়ও সততার ততখানি গভীরেই প্রোথিত।  ভাবতে ভাবতে গাছের পাতায় হাত বোলাচ্ছিল সে- যেন এই অব্যক্ত নিসর্গ তার দোসর। 

ঠিক তখনই লোকটাকে দেখা গেল। রাতের বৃষ্টি ভেজা অন্ধকারে মিশে হেঁঁটে চলেছে, হাতে খুব সম্ভবত ছোট একটা টর্চ। সে আলোয় চিনতে একটুও ভুল হল না সুকমলের- স্টেশনে ক্ষুর হাতে লোকটার বীভৎস হাসি সে সারাজীবন চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবে না। তবে কি জেল ভেঙে... 

হঠাৎই ভয়ের বদলে অদ্ভুত একটা কৌতূহল অনুভব করল সে। লোকটা কোথায় যায় দেখতে হবে, আদৌ সেদিন তাকে ওরা লক্ষ করেছে কিনা পরিষ্কার হয়ে যাবে তাও। ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে দরজা খুলল সুকমল। বাইরে এসে দরজাটা লাগিয়ে সন্তর্পণে রাস্তায় নামল। লোকটা একশো মিটারের মতো দূরত্বে রয়েছে,  সেটা বজায় রেখে সুকমল আবছায়া অন্ধকারে অনুসরণ করতে থাকলো লোকটাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগতেই আশ্চর্য শিহরণ হচ্ছে শরীর জুড়ে। তৃপ্ত সঙ্গমের আশ্লেষ এখনও তার রোমকূপগুলোকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বিপরীত দিকের বাড়িটার দেওয়ালে সুকমলের ছায়া ফুটে উঠছিল।  ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলো, বিদ্যুতের চমকে ছায়াটা আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগল; সুকমলের মনে হল তার হাত দুটো পেখমের মতো খুলে যাচ্ছে। বর্ষার ছন্দ জড়িয়ে সঙ্গম-তৃপ্ত ময়ূরের মতো হয়ে উঠছে তার ছায়া!  আশ্লেষে দু'চোখ বুজে এল তার। কয়েকটা মুহূর্তমাত্র, হঠাৎ কানফাটা গুলির শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল।  সম্ভবত লোকটা তাকে দেখে ফেলেছে, অতএব আত্মসমর্পণই বুদ্ধিমানের কাজ। মাথার উপর দু'হাত তুলে যেখানে ছিল সুকমল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু একটা নয় বেশ অনেকগুলো ভারী বুটের আওয়াজ। তবে কি পুলিশ? 

নাহ্ কেউ তার দিকে ছুটে এল না, এমনকি লক্ষও করেনি কেউ। অথচ সুকমল লক্ষ করল তার ছায়াটিকে- হাত দুটো মাথার উপর শাখা-প্রশাখার মতো উঠে এসেছে, পা-গুলো মাটির সঙ্গে জমাট। ঠিক যেন গাছের মতো অনেক কষ্ট আর প্রতিকূলতা ঠেলে উপরে উঠে আসছে ছায়াবৃক্ষটি- সহজে যার ক্ষতি স্বীকার করা চলে না। গুলি চলল আবার; এবার পরপর বার তিনেক। খুব সম্ভবত পুলিশ ও লোকটার মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ বেঁঁধেছে। মুহূর্তে সুপর্ণার সরল ঘুমন্ত মুখটা ভেসে উঠল। এখানে আর এক সেকেণ্ডও নয়; তীব্র গতিতে আঁঁধার ছুঁয়ে ছুঁয়ে সুকমল বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করল। 

দৌড়তে দৌড়তে বিপরীত দিকের বাড়িগুলো তার আবছা শরীরটিকে অস্থির হরিণে রূপান্তরিত করছিল। বিদ্যুতের মুহুর্মুহু ঝলকানিতে চমকলাগা একটি হরিণ যেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পেরিয়ে যাচ্ছে শিকারের অনন্ত রাত্রি! 

প্রায় মিনিট দশেক টানা দৌড়নোর পর বাড়ির দরজায় এসে থামল সুকমল। ভোরের আলো না ফুটলেও একটি-দু'টি পাখি সবে ডাকতে শুরু করেছে।  ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো আর গাছেদের আড়ালে সুকমলের ছায়াটা খুব ছোট্ট দেখাচ্ছিল- যেন একটা ইঁদুর গর্তের মুখের কাছে দাঁড়িয়ে মেপে নিচ্ছে অন্ধকার আর কতটা গভীর অথবা পাতলা হতে পারে। দূর থেকে আরেকবার গুলি ও আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসতেই গাছে গাছে পাখিরা চঞ্চল হয়ে উঠল। সচকিত ইঁদুরটা মুহূর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ল গর্তের ভিতর। দরজা লাগাতে লাগাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুকমল, সে নিশ্চিত জানে দিনের আলোয় ইঁদুরের ছায়াটা পাল্টে যাবে আবার। সে এও জানে পৃথিবীতে আদতে বদলে যাওয়ার শেষ বলে কিছু নেই... 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন