প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ-এর কবিতা

প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ-এর কবিতা

কোজাগরী বেদনা-বিলাস

মাঝে মাঝে লক্ষ্মী বার থেমে দাঁড়ায়। ভাঙা চাতালের গায়ে কড়া নাড়ে। স্বচ্ছ জলের পাশে সবে মাত্র গজিয়ে ওঠে ছাতিমের পোশাকি গন্ধ। একটা নিভৃত অন্ধকার। ছাদময় কোজাগরী জ্যোৎস্নার বিনুনি। দেবীমূর্তির সাবেকি চোখ। ত্রিনয়ন। চোখে টান দিয়েছিল ও পাড়ার অন্ধ- কিশোরী। তারপর থেকে লক্ষ্মী বার এখানে এসে থেমে দাঁড়ায়। আমাদের আঁকাবাঁকা শিউলি পথ ধরে হেঁটে যায় পদ্মপুকুরের দিকে।

এখানে শরৎ আসে। চলে যায়। দুধ-সাদা কাশবনে রেখে যায় লাল ছাপ। অন্ধ কিশোরীর গুটি গুটি শীর্ণ পায়ের শব্দ-গন্ধ। পূজাঞ্জলি। পুত্রান্ দেহি ধনাং দেহি। কুয়াশা-শব্দে তখন বেজে ওঠে দেবীর চোখ। ত্রিনয়ন। কিশোরীর আঁচলে বাঁধা ওম্ গন্ধ। ভেসে যায়... ক্রমশ ভেসে যায়... এক একটা দশমী-সন্ধে। 

আমরা বুঝতে পারি না, কীভাবে সন্ধে চলে যায়। সন্ধে আসে। ত্রিনয়নী অন্ধকারের পাশে ভাঙা হারমোনিয়ামের রিড। বেজে ওঠে অন্ধ কিশোরীর কোজাগরী বেদনা-বিলাস। এক একটা রেখে যাওয়া বিজয়ার সুর।

আলো

ভোর হয়। ক্লান্ত রাতের জ্বরে ছায়া হয়ে নুয়ে পড়ে জ্যোৎস্না-শরীর। ছায়া-মায়া অশরীরী গাছেদের সারি। মনে হয় যেন নারকেল পাতার ফাঁকে সরু লাল পথ এসে থামে। দীর্ঘ ক্যাকটাসে ঘেরা স্মৃতিরেখার চড়। তারপর পাখি ডাকে। কালো ঝিলে ভাসে সর্ষে-রঙের চাঁদ। আমি পারাপার দেখি। চাঁদে-জলে লেগে থাকে শঙ্খমিলন। মাঝি দাঁড় বায়। দাঁড়ের আঘাতে স্রোতের কথন শুনি। গেরুয়া পালের পাশে দীর্ঘ দীর্ঘ সময়ের ক্ষত। তারপর নদী থামে। জটাধারী দেউলের গায়ে ভৈরব-ভৈরবীর শ্রান্ত চলাচল। আমি উন্মুক্ত হয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিই। দেখি আজন্ম রাতের শেষে বৃদ্ধ বটের ডালে পাকানো ঝুড়ির মতো আলো নেমে আসে।

নীলাভ ইতিহাস

নীল জলে ভেসে ওঠে নীলাভ ইতিহাসের পাতা। পৌরানিক চরিত্রসমূহ। অগনিন নীল-পদ্ম লাল-পদ্মের নগর। ছায়াহীন রাজপথ। মুরলীধর এক বালক বাঁশি হাতে হেঁটে চলে রাখালিয়া পথে। তার নগ্ন পদ। আলুথালু কেশ। নীল ময়ূর পুচ্ছে সজ্জিত নীলাম্বর। মায়ের কণ্ঠের মতো আকাশ বাজায় সে। গড়িয়ে পড়ে ললিত-সুর। সুরেলা বাতাস। বাতাসে কালিন্দী গন্ধ। অথবা বৃন্দাবনে ভেসে যায় কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম। রাই-কিশোরীর চোখে তখন জলছবির ঘেরা বাদল-নিনাদ। কদমবনে বিরহ আঁখি। মথুরার পথে পথে বালিকা বধূর স্মৃতি আর ধুলো-মাটি। বাঁশিমুখী কিশোর ছেড়ে গেছে তার সমূহ অতীত। অতীতের মায়া-মোহ। বাঁশি বাজাতে বাজাতে নেমে গেছে ধুলো পথে। ছেড়ে গেছে সব ঋণ। বধুটিও হেঁটে চলে পথে পথে। তার অমলিন স্মৃতিপটে ধুলোটুকু নিয়ে। ছেড়ে গেছে মুরলী-সুর। মা-ময় ইতিহাসে নীলাভ পাতার গায়ে নীলটুকু ঢেলে। 

মা মা গন্ধ

বহুকাল হাঁটিনি এ শহরে। পথের কানায় ভরা বিনম্র ধুলোর গায়ে। ছড়ানো সকালে যেখানে শিউলি মঞ্জরীর ওড়াউড়ি। দালান বেয়ে গড়িয়ে আসে ধুনো-গন্ধ। তারপর হেঁটে যাই। পিঠ পেতে শুয়ে থাকা নদীর বাঁকে স্বেত ডানা আলো মেলে উড়ে যায় মেঘ। কালো-সাদা কাশবন। সরু গলি। নদীর গায়ের রঙে ছায়া ফেলে পাখির পালক। তারপর নদী-মাটি। ধূপ পোড়া হলুদ আকাশ। মাটি গাঁথে কুমোরের ঘরে। লাল নীল সবুজ ঘাসে ছেয়ে ওঠে কুটির দালান। সাদা সাদা মাটির রঙে দুমুঠো স্বপ্ন ছড়ায় তারা। কাদা লেপে পৃথিবীর বুকে। কুমোরের বউ নগ্ন শরীরে দাঁড়িয়ে থাকে দু'হাত মেলে। কুমোর মাটি গাঁথে। গড়ন দেয়। এ শহরের বুকে তারা মা মা গন্ধ ছড়ায়।

 


1 টি মন্তব্য:

  1. প্রতিটি কবিতাই চমৎকার। তোমার লেখার একটা নিজস্ব চলন আছে। শব্দ ব্যবহার ভালো লাগল।আরো লেখ।

    উত্তরমুছুন