রূপায়ণ ঘোষ-এর কবিতা
The wind does not know how to dry tears.
- Louis Aragon
মাঝে মাঝে অন্ধকার কী অমোঘ মনে হয়
যতদূর দেখা যায় তা আসলে গভীর বিন্যাস ;
অথচ এখানেই সবচেয়ে অস্ফুট আমরা
বাক্যহীন, বিস্ময়নিথর!
আসলে আঁধারের ভীতরগামী সবকিছু
স্বতন্ত্র শীতল-
তবুও সম্পৃক্ত রাত্রি এলে
প্রকীর্ণ অশ্রু গাঢ় হয়
থেমে যায় অকম্প হাত, অসুস্থ কথন।
পথ্য ভেঙে নাও শরীরের; আসুক অচিহ্নিত শল্যরস
বৃক্ষের গায়ে গায়ে মানুষের কুয়াশা-নিনাদ
কিচ্ছু না, এ শব্দ কেবল সারিবদ্ধ অপরাধের
হাওয়ার মতো যারা অস্ফুরিত
ছুঁয়ে আসে অশ্রুচোখ।
তবু দেখি চিবুক ছোঁয় স্তব্ধ প্রলম্বিত জল
প্রতিটি ছায়া আদতে আলোর বিপরীতগামী পরম্পরা
যা স্থিরলক্ষ্য, যা মৃত্যুস্বাধীন-
ভাসিয়েছে দৃষ্টির শাশ্বতিক বধিরতা।
একটি তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল আকাঙ্ক্ষা
আমাদের প্রতিটি পালকে শৈশব লেখা থাকে
লেখা থাকে অমেয় খনন-
যে আশ্চর্য রঙিন পৃথিবীর কথা ভেবেছি আমরা
সেখানে নেমে আসা মানুষের তীক্ষ্ণ মৃত্যুময়তা,
একদিন শেষ হতে হতে স্তব্ধ হবে।
মানুষের সমস্ত সত্যের জন্য
এখানে শুধু নির্মেদ চরাচর থেকে যাবে...
ঈশ্বর ও প্রতিদ্বন্দ্বী
একজন লোক অন্য একটি লোককে প্রশ্ন করলো,
''কি করে ঈশ্বর হতে হয় জানো?''
দ্বিতীয় লোকটি মুচকি হাসল, ভাবখানা এমন-
যেন ঈশ্বর হয়ে ওঠাটা নিতান্তই ছেলেভুলোনো কাজ!
প্রথম ব্যক্তিটি পুনর্বার প্রশ্ন করলো- ''হাসছ যে?''
দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখ অন্ধকার হল;
ভাবটা এমন- যেন হাসির কারণ জিগ্যেস করাটা পৃথিবীর সবথেকে বড়ো অন্যায়!
সে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই
প্রথম লোকটি তার জামার আস্তিন চেপে ধরলো, ''বললে না তো কি করে ঈশ্বর হয়ে ওঠা যায়?''
দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এবার কঠিন চোখে তাকাল প্রশ্নকর্তার দিকে- দৃষ্টিতে তীব্র আগুন।
কঠোর মুষ্টিতে চেপে ধরলো তার হাত, "ঈশ্বর হতে চাও? জানো ঈশ্বর হওয়ার আগে একটি প্রাণকে নারী হতে হয়।"
বিস্মিত চোখে তাঁর দিকে চেয়ে রইল প্রশ্নকর্তা...
অতঃপর,
উত্তরদাতা হাত ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো গভীর অরণ্যের দিকে
পিছন পিছন বিস্মিত মানুষটি।
দ্বিতীয় ব্যক্তিটি আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে একটি নীল সরোবরের মধ্যে
সমস্ত অরণ্য জুড়ে অস্ফুট ধ্বনিতে ভেসে যায় চতুর্দিক-
"নারীদের মধ্যে আমিই কীর্তি, শ্রী, স্মৃতি
আমিই মেধা, ধৃতি- আমিই ক্ষমা..."
অতঃপর লোকটি ডুবে গেল জলের অতল রহস্যে
পুনর্বার শোনা গেল এক মোহন বাঁশির সুর!
সেই প্রথম ব্যক্তি, অরণ্যের পথ ধরে ফিরতে শুরু করলেন
তিনি হাঁটছেন- ঈশ্বর ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী
ধীরে ধীরে হয়ে উঠছেন প্রেমগর্ভ, ক্ষমারহস্য
হয়ে উঠছে সময়, দীর্ঘ করুণাগামী...
এক সুগন্ধ-ভবিষ্য আলো
তাহলে আমাদের আর কোনও অতীত চারণ রইল না
এই ভাবনা থেকে হিম হয়ে আসে শোণিতগামী দেহ
জীবনের বৃত্তের মাঝে প্রণয়মুদ্রা
বিমুক্ত কড়ির মতো গেঁথে রাখে ছকচক্র
শুধু ঘুঁঁটি পড়ে থাকে জগৎকথার-
এরপর পতনগামী সবকিছু
হা হা মন্ত্ররবে তুলে নেয় সমিধমাণ্য পাত্র।
যেন আমাদের ভূত-ভবিষ্যহীন পৃথিবীতে
ভ্রূ-বিন্যাস করে নিমেষিত অন্ধ চোখ...
তখনই কড়িচক্র ভেঙে
উড়ে আসে এক আনন্দ-অসুখ জোনাকি।
একটি শস্যময় আকাঙ্ক্ষাপাত্রের জন্য সে উজ্জ্বল
বসে থাকে মানুষের কম্পিত সমুদ্রে।
বেলাভূমি জুড়ে,
ভারশূন্য কত বিদূষক এসে পড়ে স্তব্ধ চপলতা হাতে-
সমগ্র নিসর্গ এই আন্দোলিত অপেক্ষায়, ক্রমশ আলো-নির্ভোগ
অথচ মৃদঙ্গ আলোরা- প্রকৃত অন্ধকার হলে
টেনে নেয় সমস্ত প্রত্যাশিত চোখ!
ক্রোধ, জন্মগামী
সঙ্গমের অনতিপূর্বে,
তুমি অস্বীকার করছ সহবাস
অসংবৃত হতে এত ভয়!
অথচ দ্যাখো, একাকী অনাবৃততাও আড়াল একরকম...
প্রতিটি ইভের লজ্জা থেকে মানুষের জন্ম সরে যায়
শরীরী রাত্রির পাশে জেগে থাকা অনঘ সময়
উত্তেজক সমস্ত হত্যা পেরিয়ে
মানুষের তাঁবুর কাছে ভেসে থাকে ঢেউ অগণন
কেননা লজ্জা ততখানি বলিষ্ঠ নয়
যতটা ক্রোধ কিংবা চুম্বন...
কবি বার বার পাঠকমন ছুঁয়ে যাচ্ছেন প্রগাঢ় নিপুণতায়। তার এই কবিতাযাপন এবং মননশৈলী ছড়িয়ে পড়ুক দূরদূরান্তে। মুগ্ধ কবি!
উত্তরমুছুনভীষণ সুন্দর কবিতাগুলো
উত্তরমুছুন