সৌম্যজিৎ রজকের কবিতা

সৌম্যজিৎ রজকের কবিতা 




ভাইব্রেশন

ইদানিং ফোন বেজে উঠলেই মনে হয়
কেউ নির্ঘাত
        মারা গেল এইমাত্র
খুব কাছেই, হয়তো খানিক দূরে
এসব খবর না পেলেও আমার
কীই বা যায় আসে, রামকিঙ্কর?
অভীককে ফোন করলে শুনতে হবে
কাজটা চলে গেছে, মাও আর উঠতে পারছে না
অর্পিতাদি জানাবে নতুন কাজ জোটেনি এখনও
আকাশকে ফোন করে কি খবর নেব
                        বৃষ্টি নামবে কবে?
ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পারল আবীর?
বাবাকে পুড়িয়ে ফিরল কি এতক্ষণে?
ইদানিং ফোন বেজে উঠলেই মনে হয়
নড়ে উঠছে অস্তিত্ব
গোঁ গোঁ করছে আর
থরথর করছে আমার ভেতর
কোনও মৃত্যু সংবাদ
মরা মানুষের ফোন নম্বর পকেটে কাঁপছে…
 

বাতিল বাড়িঘর

কিছু মুখ ভেসে আছে হাওয়ায় হাওয়ায়
কিছু ডাক লেগে আছে দেয়ালে পাঁচিলে
 
রূপেনবাবুও আর নেই পৃথিবীতে
 
মাটির ওপরে আর আকাশের নিচে
ভেসে আছে আমার বাতিল বাড়িঘর
 

মড়ক

কেউ কি এখনো বেঁচে আছে এই
মৃতের শহরে?
 
তুমি ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেছ
   ধোঁয়ার ভেতর!
 
কেউ কি এখনো বেঁচে আছে, ছুঁলে
নড়ে উঠতে পারে?
 

যে খবর রটেছে তা মিথ্যা

বিচ্ছেদের খবর কিছু রটেছে বাজারে,
                আমি বিশ্বাস করিনি!
এই তো পরের মাসেই
দেখা হবে আমাদের।
তাই না কি?
 
জীবন কি লজেন্সের মোড়ক,
খুললাম আর ফেলে দিলাম?
 
ছেলেখেলা?
 
কারও কোনো কথাতেই আমি
বিশ্বাস করছি না।
তাড়াতাড়ি দেখা হোক আমাদের।
ব্যাস্‌! 
 

অনড় ছবির মতো

সূর্য উঠেছে অথচ সম্পূর্ণ যায়নি ডুবে চাঁদ
আমি তোমার কথাই ভেবে চলেছি তখনো।
রোজ এই এক বেঁচে থাকা, একঘেঁয়ে পৃথিবীতে
কার আর ভালো লাগে, বলো!
সেই এক স্বর্গের মোহ, সেই একই নরকের ভয়
কোথাও কোনও গতি নেই
অনড় ছবির মতো
রোজ এক ঝুলে থাকা জীবন দেয়ালে!
 
এই এক বিরহ এমন চাঁদ ডুবে গেছে আর
সূর্যও উঠছে না কিছুতেই।
 

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়

একই ওড়নায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ল
প্রেমিক প্রেমিকা রাকাবের জঙ্গলে
এক কাপ চা নিয়ে কেউ
                তফাতে দাঁড়াল
ব্যস্ত মানুষেরা হুহু গাড়ি চলে গেল বড় রাস্তা দিয়ে
 
সমাধানের পথ কি ওদিকেই?
 
রাকাবের জঙ্গলে সমাধান নেই,
গাছের আড়ালটুকু আছে
ঘনিষ্ঠ হওয়ার…  
 

খুঁটিনাটি

রাস্তার ধারে সারে সারে—
ওদের শরীর যদি মাটির তৈরি হয়
তাহলে দেবতা আর
রক্তমাংসের হলে দেহব্যবসায়ী
এমনই অমোঘ কিছু
স্ববিরোধিতা নিয়ে
বেড়ে উঠেছে তোমাদের সভ্যতা
 
এইখানে পটুয়াপাড়ার পাশে রাতজাগা কালীঘাট,
ক্যাওড়াতলাও তো অনতিদূরেই!
অর্থাৎ দেবতার জন্মস্থান থেকে মানুষেরা
শ্মশানের দিকে এগোতে চাইলে
বেশ্যাদের অপেক্ষার ভেতর দিয়েই এগোতে হবে,
তোমাদের শহরের নিয়ম এমনই!
 
তোমাদের শহরের এরকম নানাবিধ খুঁটিনাটি
যারপরনাই বিব্রত করে
আমাকে, শরীফ! 
 

সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে লেখা

পরিস্থিতি আমাদের কাছে আসতে দিচ্ছে না
তবে দূরে সরে যাওয়াটা আমাদেরই সিদ্ধান্ত,
                        একান্তই আমাদের
এখন তোমাকে সেই নক্ষত্রটির মতো লাগে
মাটি থেকে যতদূরে দেখি,
ছাদে উঠলেও দূরত্ব কমে না
নিজেরই তাপে ঘেঁষতে দাও না কাছে----
দুঃখ আমারও চারপাশে
এখন বলয়
 
নিজ নিজ অক্ষে এই নিজস্ব ঘূর্ণণ
একদিন থেমে যাবে ঠিক
 
সেও কোনও নতুন বিরহ না!
 

শিল্প

বিষণ্ণতা নিয়ে বহু কথা হ’ল— দীর্ঘক্ষণ ধরে!
কাঁধে হাত রেখে অনেকে জানিয়ে গেল,
                        ‘পাশে আছি’
 
থাকা আর না থাকার মাঝে যে ধূসর এলাকা
সেদিকে কীসের টান?
 
‘বেঁচে থাকা এক ধরণের শিল্প’—
 
বেঁচে বর্তে থাকো, বন্ধুরা আমার;
আমাকে থাকতে দাও উস্কোখুস্কো লোকেদের মতো
তোমাদের নাচাগানা দেখে হাততালি দেবে যারা
মাঝেমাঝে হলের বাইরে গিয়ে 
বিড়ি খেয়ে আসবে কখনও!
 

রেওয়াজ

কত লোকে কত কারণে যে মরতে চায়
তুমি যদি জানতে, বাঁচার ইচ্ছেই চলে যেত, রামকিঙ্কর!
ছাদ থেকে যেটুকু দেখছে,
                পৃথিবী কি সেটুকুই নাকি?
কমলালেবুর মতন চ্যাপ্টা? ওপরে ও নিচে!
কার তর্জনী, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের চাপে?
জীবন প্রলম্বিত, জীবন তো ধীর লয়ে
এগিয়ে চলেছে শেষ
      স্বরটির দিকে…
মন্ত্রমুগ্ধ আমরা,
অভিভূত হয়ে আছি।


স্মৃতির কোয়ারেন্টাইন

মাথাভর্তি শব্দ নিয়ে ঘুম ভাঙে কারও
কারও সম্পূর্ণ শূন্যতায়—
‘কবিতা লিখতে হবে, লিখতেই হবে’
                        এও এক অপচয়!
 
তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াব আরেকদিন,
কথা তো এটুকুই!
 
সেবার পাহাড় দেখতে গিয়েছিলাম নাকি সাগরের উপকূল?
সূর্য অস্ত যাচ্ছিল তখন?
                নাকি সূর্যোদয়?
তুমি পাশে ছিলে, এই কথাটুকু ছাড়া
কিছুই মনে নেই আমার, কিচ্ছু না!
 
আমরা একাকী ছিলাম— বিপুল এক আকাশের নিচে
ছিলাম একত্রে!
 

ড্রয়িং স্কুল

তোমার আঁকার খাতায় কী এঁকেছো বালক?
নদী? কোনো নদীর কিনার ঘেঁষে
বিপুল আকাশ?
আকাশে কয়টি তারা তুমি কি জ্বেলেছো?
 
শিশু তো দিনের আকাশ!
 
আমিও তোমার মতো সহসা কল্পনাপ্রবণ—
কল্পনা করি, পাখিদের ওড়াউড়ি!
তোমার ছবিতে, কচি
পাখির পালক—
মানুষের পৃথিবীতে যেমন মৃত্যু
হুবহূ তেমনই এঁকেছো।
 

ঠাকুমা

মানুষটার সাথে সাথে, দেখি, বিছানায় মিশে গেছে
আমার শৈশব—
একেই তো মৃত্যুশয্যা বলে,
মৃত্যুসজ্জাও বলতে পারেন!
 
যে শব্দই ব্যবহৃত হোক,
মৃত্যু কিন্তু পাল্টাচ্ছে না, খেয়াল করুন!
 
শব্দ থেকে পৃথক শব্দে, উপমা থেকে অন্য উপমায়
মৃত্যুর রূপভেদ নেই।
এমনই সে অনড়, একরোখা।
 

আমার আর সহ্য হচ্ছে না, রামকিঙ্কর

সহজ কথাটা
সোজাসাপ্টা
বলতে চেয়েছি।
তার বেশি আর
কীইবা চেয়েছি জীবনে?
 
জীবন বিরক্তিকর, ঘ্যানঘ্যানে, বাজে!
 
সহজ কথাটা ব’লে
চুকিয়ে ফেলতে চেয়েছি সব
                হিসেব নিকেষ।
 
মৃত্যুর সাথে কোনও
বাওয়ালে জড়াইনি কোনোদিন।

তবুও রাতদিন কেন জ্বালাতন করে এত?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন