মহাসপ্তমীর গল্প

একটি গ্রাম

উৎপল মান 

 গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা আছে চারদিক। রিমঝিম ওয়েডিং হল, গিফট আইটেমের দোকান, মোবাইল শো-রুম কত সামনে, অথচ দেখা যাচ্ছে না কোনওটাই। এদের উল্টোদিকে রাস্তা পেরিয়ে একটি সেকেলে চায়ের দোকান। দোকানের পিছন দিকটা ঝোপঝাড় ও গাছপালায় ভরা। তার নীচে পুকুর। বিশাল পুকুর। বহু পুরনো।  

   কোনও কিছুই ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না আজ। এত ঠাণ্ডা পড়েছে। তার ওপর আবার এত বেলা অব্দি কুয়াশা। শহুরে কলোনির পরিবর্তে জায়গাটাকে নিছক একটা গ্রাম মনে হচ্ছে। সাদাকালো বিমূর্ত ছবির মতো এক অদ্ভুত দৃশ্যায়ন। জায়গাটাকে বেশ রহস্যময় লাগছে।

   বাজার করতে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি। প্রতিবারের মতো এই বছরেও পরিযায়ী পাখির দল পুকুরে আস্তানা নিয়েছে। প্রায় এক মেঘ কালো পাখি। ওরা মাঝে মাঝে একটি মেঘ হয়ে অল্প উচ্চতায় উঠে আবার পুকুরে নেমে আসছে। এই দৃশ্য দেখার জন্য আমি ছাড়া আরও দু’একজন এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে রয়েছে। কয়েকজন রয়েছে চায়ের দোকানে। 

   হ্ঠাৎ দেখি একজন বয়স্ক লোক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। মুখোমুখি হতেই জিগ্যেস করলেন আমাকে, ‘কী পাখি জানেন?’ 

   ‘না।’ আমি হতভম্ব হয়ে বললাম।  

   ‘কোথা থেকে আসে জানেন?’

   ‘না।’

   ‘কিছুই জানেন না দেখছি! আবার হাঁ করে তাকিয়েও আছেন!’

   আমি সত্যিই এবার ভ্যাবলা ছেলের মতো ওনার দিকে তাকালাম। ভদ্রলোক হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন। যেতে যেতে বলতে লাগলেন, ‘ওগুলো গডউইট গডউইট, আইসল্যান্ড থেকে আসে ওরা।’ 

   চায়ের দোকানে যে-কয়েকজন রয়েছেন তাঁরা সকলেই বৃদ্ধ। শীতবস্ত্রে আদোপান্ত ঢাকা ওঁদের শরীর। কিন্তু এই গরিব দোকানটিতে উষ্ণ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ওরা বেশ বিন্দাস, স্বাধীন। 

   বাঁশের খুঁটি আর চাঁচের ছাউনি দিয়ে দোকানঘর। চাঁচের মাথায় অবশ্য পলিথিন দেওয়া। চারপাশের দেয়াল বলতে কিছু নেই। মাটিতে খুঁটি পুঁতে বাঁশের বাতা দিয়ে বেঞ্চি বানানো হয়েছে। বুড়োরা দিব্যি জমিয়ে বসে চা পান করছেন। সঙ্গে গরম চপ। ঘরে সম্ভবত এসব খাওয়া নিষিদ্ধ।  বাইরে খেলে কে দেখছে! তাছাড়া আজকের দিনটা এত কুয়াশাময়, আঁধারি আর ঠাণ্ডা যে এসব খাবার বেশ জমিয়ে খেতে ইচ্ছে করে।   

   আমার চোখেও একটা ঘোর লেগে গেছে। বহুদিন পর আমার মনে হচ্ছে, আমি একটা গ্রামের মধ্যে আছি। কিছুটা বেলা হয়েছে, তবু রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা, শান্ত। যানবাহনের প্রতুলতা নেই। আকাশ ফুঁড়ে দেওয়া ফ্ল্যাটবাড়ির উচ্চ শির নজরে পড়ছে না একটাও। বরং হাঁটতে হাঁটতে একটা অন্য রাস্তা আছে। সেই রাস্তার অভিমুখ দেখা যায় না। যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই ওর লক্ষ্য।  

   মুখে সাদা দাড়ি। খিটখিটে চেহারা। ঢোলা পুরনো কোট গায়ে। হাতে লাঠি। শ্যামকাকা নাকি? সামনের দিকে একটু ঝুঁকে হাঁটা অভ্যাস। ধুর, শ্যামকাকা গ্রাম থেকে এখানে কী জন্যে আসবে!  

   আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। রীতিমতো জরিপ করে বুঝলাম, হতেই পারে না। কিন্তু যেই পিছু ঘুরেছি অমনি শুনতে পেলাম- ‘কী হে ছোকরা, চেনা মনে হচ্ছে যেন!’ 

   ‘আমাকে?’  

   বুড়ো একগাল হাসলেন। বললেন, ‘বুঝি বুঝি।’

   আমি অবাক। উনি কী বোঝেন? আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম ওনার দিকে। জানতে চাইলাম, ‘মানে?’ 

   উনি লাঠিতে অল্প শব্দ করে ওটাকে শূন্যের দিকে মুখ উঁচিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো।’

   আমি ওঁর লাঠির অভিমুখে শূন্যে তাকালাম। দেখলাম, পাখিরা গোলাকার একটি মেঘ তৈরি করে ওই বলয়ের মধ্যে পাক খাচ্ছে। আর ওদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে জায়গাটা। আমি বুঝলাম না উনি কী বলতে চাইছেন। শুধু জানতে চাইলাম, ‘কী পাখি জানেন?’

   ‘সে কী হে, নাম জানো না!’  

   ‘আজ্ঞে না।’ আমি আগের বৃদ্ধের কাছে যা শুনেছিলাম তা বললাম না। ইনি কী বলেন শোনার ইচ্ছে হল।

   বৃদ্ধ বেশ একটা সবজান্তার ভাব নিয়ে বললেন, ‘বলিহারি! ওগুলো নাইটহেরন, বুঝলে। ইউরেশিয়া থেকে এসেছে।’ 

   ‘কিন্তু আমাকে চেনা লাগছে, না কী যেন বললেন?’

   ‘হুঁ হুঁ, পৃথিবীর সকলেই সকলের চেনা। শুধু চিনে নেওয়ার চক্ষুটিকে সজাগ রাখতে হবে, বুঝলে হে ছোকরা?’ 

   ‘সেটা আবার কেমন চোখ?’ আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। 

   উনি আবার লাঠিটি পাখিদের দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘ওই ওদের মতো। বুঝলে কি না?’

   আমি হাঁ করে আবার পাখিদের দিকে তাকালাম। ওদের চোখ নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গভীরতা মাপতে পারলাম না। মাপা যায় নাকি আদৌ! হয়তো পাখির নীড়ের মতো চোখ। এসব ভাবছি ঠিক তখনই দেখলাম, বৃদ্ধ লোকটি কী-সব বলতে বলতে চলে যাচ্ছেন। ভাবলাম পাগল নয় তো! 

   শ্যামকাকা শেষ বয়সে পাগল হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় যাকে দেখত তাকেই কিছু-না-কিছু প্রশ্ন করত। হরেক কিসিমের বিচিত্র সব প্রশ্ন। উত্তর না পেলে একটা কথাই বলত, ‘তোরা রাস্তাটাই জানিস না।’ 

   আমরা বলতাম, ‘কোথাকার রাস্তা গো? কোন রাস্তা?’   

   শ্যামকাকা মুখ-ভরা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলত, ‘কেন, রাস্তা আবার ক’টা হয়! একটাই তো রাস্তা বাপু। জীবনের।’ বলেই প্রায় এমনভাবে হাঁটা দিত যেন এখনই না গেলে সে রাস্তা আর পাওয়া যাবে না।

   আমরা মুখ টিপে হাসতাম। তারপর চুপচাপ যে-যার রাস্তা দেখতাম। কিন্তু শ্যামকাকার বিরাম ছিল না- না হাঁটার, না প্রশ্নের। ওকে দেখে মনে হত, জীবনের গভীরতম দিক খুঁজতে গিয়েই কি মানুষ পাগল হয়ে যায়! 

   রাস্তার দিকে তাকালাম। বৃদ্ধকে দেখা গেল না আর।       

   ঘুরতে ঘুরতে পুকুরের পূর্ব দিকের পাড় বরাবর রাস্তার ওপর এসে দাঁড়িয়েছি। ঘন কুয়াশার ম্যাজিক অল্প কিছু গাছকে নিয়ে যেন একটা অরণ্য বানিয়ে ফেলেছে। পুকুরের ধারে নলখাগড়া জাতীয় জলজ, দীর্ঘ আগাছাগুলিও রহস্যের ঘেরাটোপে মগ্ন হয়ে আছে। নিঝুম, ঝুপ্পুস হয়ে আছে চৌহদ্দিটা। পুকুর পাড়ে একটি ছাইগাদায় গোটা-দুই কুকুর হুটোপুটি করছে, গড়াগড়ি দিচ্ছে। 

   ‘আরে পঙ্কজ না?’    

   আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক মাথা থেকে হেলমেট খুলছে। বাইক থেকে নেমে আগেই আমাকে দেখেছে তার মানে। 

   আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্রীধর! আমার পাশের গ্রামের ছেলে। এখন এই শহরেই থাকে। ‘কোথাও বেরিয়েছিস মনে হচ্ছে? এই সাতসকালে কোথায় রে?’ 

   ‘হ্যাঁ। দেশের বাড়ি যাচ্ছি।’ শ্রীধর জানাল। 

   ‘মাঝে মাঝেই যাস, তাই না?’ 

   ‘কই যাওয়া হয়! মাত্র কুড়ি কিমি দূরে গ্রাম। অথচ প্রায় ছ-মাস পর বাড়ি যাচ্ছি।’

   ‘আমার তো তা-ও হয় না রে।’ 

   ‘অথচ দ্যাখ’, শ্রীধর পুকুরের ওপর শূন্যে উড়তে থাকা পাখিদের দেখিয়ে বলল, ‘এই পরিযায়ী পাখিরা বছরে একবার অন্য দেশে যায়। কিছুদিন সেখানে থেকে আবার নিজের দেশে ফিরে যায়।’   

   ‘কিন্তু আমাদের আর ফেরা হয় না, যাওয়া হয় না।’

   ‘ভোগ আর চর্বির ভিতর ডুবে গেছি যে। আমাদের আত্মীয়জনদের ভুলে গেছি। শিকড় খুঁজতে গিয়ে আমাদের আর মনখারাপ হয় না রে।”  

   ‘তবু কষ্টটা মাঝে মাঝে বিঁধে দেয়, বল? জানিস, মাঝে মাঝে বন্ধুদের স্বপ্নে দেখি। আলো কমে আসা ক্রিকেটের মাঠ। সন্ধের আকাশে ঘুড়িটা দূরবর্তী হয়ে আর ফিরে আসছে না, অথচ হাতে ধরা লাটাইয়ের সুতো গুটিয়েই চলেছি।’ আমি আবেগঘন হয়ে পড়ছিলাম।   

   বিষণ্ণ হাসল শ্রীধর। বলল, ‘ওসব তো ঘুমিয়ে আছে বহুদিন। আমি আর গ্রামে গিয়েও পাই না কিছু। ওসব ভাবলে কেবলই মনখারাপ করতে থাকে।’ শ্রীধর এরপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ। আমিও কোনও কথা বললাম পারলাম না। যেন দু’জনেরই কিছু হারিয়ে গেছে যা আমরা খুঁজে চলেছি। রাস্তা বেশি দূর দেখা যায় না। তবু আমরা যেন সেদিকেই তাকিয়ে থাকলাম। মুহূর্ত পরে শ্রীধর ‘আসি এবার, পরে দেখা হবে’ বলে বাইকে স্টার্ট দিল। আমি কিছু বলার আগেই ও চলে গেল হুস্‌ করে। আমি ওর লাল হেলমেট কুয়াশায় মিলিয়ে যেতে দেখলাম। মনে মনে আউড়ালাম, “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ।”         

   পুকুরের পাড়ে উঠে এসে দেখলাম এখান থেকে চা-দোকানের পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। লোকের বাড়িতে বাগান পরিচর্যার জন্য গ্রাম থেকে আসা মালিরা দোকানে ভিড় জমিয়েছে সম্ভবত।  কিন্তু পুকুরের পাড়টা যে এত আগাছা আর হাবিজাবি গাছে ভরে গেছে, জানতাম না। আমি এইসব পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি পুকুরের দিকে। পুকুরের মাঝ থেকে যেন কুয়াশার একটা চূড়া উঠে গেছে। জলজ লতাপাতার ওপর, জলের ওপর গাঢ় কালো আস্তরণের মতো বসে আছে বহুসংখ্যক পাখি। আশ্চর্য পরিযায়ী পাখি। দুই বৃদ্ধ পাখিগুলোর নাম দু’রকম বলেছেন।   

   আমি জলের কাছে এসে দাঁড়ালাম। নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু মনে হচ্ছে জলের ভিতরে নানা সিঁড়ি রয়েছে। গভীরে চলে যাওয়া অসংখ্য সিঁড়ি। আমি একটি করে সিঁড়িতে পা দিয়ে দিয়ে অনেক নীচে নামতে থাকি। নেমে যেতে থাকি। সিঁড়ির কি শেষ নেই! আমি নামতে নামতে থমকে দাঁড়াই হঠাৎ। দেখি আমার প্রাচীন ঠাকুরমা চুল শুকোচ্ছেন রোদের উঠোনে। ঠাকুরমার সাদা চুলে অলৌকিক মেঘ। আর তাঁর সামনে চাটাইয়ের ওপর মেলে রাখা ধান। হুস্‌হাস্‌ শব্দ করে মাঝে মাঝে পাখি তাড়াচ্ছেন ঠাকুরমা। দেখি আমার মা একটি বালকের কপালে দই-হলুদের তিলক এঁকে দিচ্ছে। বালকটি মা-কে প্রণাম করে স্কুলে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। ওই তো শুয়ে আছে বাবা। কারখানা থেকে ফিরে লম্ফ-র আলোয় নভেল পড়ছে। আর ওই যে, আমার কিশোরী প্রেমিকা, পড়ার ঘরের জানলা থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এখনও। আমি ওকে প্রশ্রয় দিয়ে সরে পড়েছিলাম। শুনেছি এই শহরেরই কোথাও আছে সে। একদিন কি দেখা হয়ে যাবে? কী বলব সেদিন ওকে? 

   জলের আরও অনেক নীচে শীতের ঠোঁটফাটা নদী। নদীর তীরে সাজানো চিতায় পুড়ে যাচ্ছে বাল্যবন্ধু অনাদির দেহ। বিজয়ের। স্বপ্নে আমি এখনও এদের সাথে খেলা করি, ঝগড়া করি। আমড়া ফলের শুকনো আঁটিতে পালক গুঁজে শূন্যে নিক্ষেপ করে উদাস তাকিয়ে থাকি। 

   আমি জলের আরও অনেক গভীরে নেমে যাই। কোথাও তল নেই। একটা হাহাকার, একটা শূন্যতা আমাকে বিষণ্ণ করে তুলছে ক্রমশ। আমি একটা পথ খুঁজতে থাকি। শ্যামকাকা বলেছিল, একটাই নাকি পথ। সেটা জীবনের। আমার এখন জানতে ইচ্ছে করছে খুব, জীবনের পথটা কেমন শ্যামকাকা!      

   আমার ঘোর ভেঙ্গে গেল। পাখিদের চিৎকারে। ওদের উড়ান দেখতে রাস্তা থেকে কেউ ঢিল ছুড়েছে নিশ্চয়। ওরা চঞ্চল হয়ে উড়তে শুরু করেছে। আমি রাস্তায় উঠে এলাম। চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালাম আবার। কয়েকটা খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পলকা চালাঘর। দোকানে তখন সাধুগোছের একটি লোক বাউল গান করছেন। ভিক্ষের ঝুলি কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন আরেক বৃদ্ধ। শ্যামকাকা না? চমকে উঠি আমি। আমার হাহাকার শুনতে পায় না এই তামাম দুনিয়া। 

   চারদিক তাকয়ে দেখি, মেঘ আর কুয়াশার কুহেলিকায় এই শহরটা লুপ্ত হয়ে গেছে আজ। জেগে আছে একটি গ্রাম। যেন সন্ধ্যা নামছে গ্রামে। রেবতী দাসের আখড়া থেকে ভেসে আসছে গান। দূরের মাঠ থেকে হেঁটে আসছে শীতবোঝাই বিষণ্ণ পথ। আর আমি, একটি বালক, গায়ে মায়ের বেঁধে দেওয়া সুতির চাদর মুড়ে আনমনা চেয়ে আছি অনেক দূরে। এই শহর থেকে দৃশ্য-বিরল দূরে।    

 

 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন