মহাষ্টমীর গল্প

মাধুকরী 

অরণ্যা সরকার



‘এই খানকি মাগি চুপ কর না।’ দোকানের  সিঁড়িতে  লাল প্লাস্টিকের ট্রের মধ্যে দুধের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে   বুড়োটা চেঁচিয়ে উঠলো। দোকানের একপাশে কর্পোরেশনের কল। সরু হয়ে জল পড়ছে।   টুলে বসে ছোট রঙের কৌটোয়  জল ভরে ভরে বালতিতে ঢালছে বুড়োর উল্লেখিত খানকি মাগি। জল থেকে মুখ তুলে সেও চিৎকার করে উঠলো, ‘তুই চুপ কর   ঢ্যামনা বুড়ো। সকাল থেকে বসেই তো আছিস। খদ্দের এসে ঘুরে যায়, আবার কতা বলে।’  প্রায় সব কটি দাঁত বের করে হাফ   প্যান্টে হাত মুছতে মুছতে খদ্দের আসে দোকানে। ‘জমে ক্ষীর। ও দাদু, আজকে কি পালা ?’ দুজনেই চুপ করে যায়। বুড়ো  দোকানে ঢোকে।  ‘এক কেজি আলু দাও দেখি।’  বুড়ি আবার সরব হয়। ‘দ্যাক না খালি বিড়ি ফোঁকে আর চা খেতে উটে উটে  যায়। দোকানের দিকে মন  আছে ? এইভাবে দোকান চলে ?’ ‘ঠিকই তো, ও দাদু এক কেজি পেঁয়াজও দিও।  কত করে নিচ্ছ   ?’ ‘আশি টাকা ; ও বাবা কম হবেনা ?’  পাথরের মত মুখে বুড়ো বলে, ‘না।’  ‘তাহলে আ ড়াইশোই দাও।  ঝোলানো চিপ্সের  প্যাকেট থেকে একটা ছিঁড়ে নিতে নিতে খদ্দের বলে, ‘এই দ্যাখো, একটা নিলাম। কত হল ?’  
রনিতা এবার দৃষ্টি ঘোরায়। সাইকেলের দোকান।  লম্বা পাইপ দিয়ে নিজেই চাকায় হাওয়া ভরে দোকানদারের হাতে টাকা দিয়ে চলে গেল একজন। দোকানদার একটা শোয়ানো সাইকেলের চাকা ঘুরিয়ে চলেছে একমনে।  মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে রাস্তার দিকে।  
পাশের সেলুনে হলুদ টাওয়েল জড়িয়ে চেয়ারে চোখ বুজে আছে একজন মধ্যবয়সী। ওর তোবড়ানো গালে ফেনাভর্তি ব্রাশ চালাচ্ছে অন্যজন। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের  শুষে নেওয়া আরামটুকু উপভোগ  করছে। অন্যজন  অভ্যস্ত হাত চালাতে চালাতে হয়তো মাথার ভেতর  মলে  দেখে আসা  হাবিবস স্যালোনের ছাপ তুলে  নেবার চেষ্টা করছে। পারছে কি ?  ঝকঝকে   ছবিটা কি বারবার ছিটকে যাচ্ছেনা ?  মাথায় ম্যাসাজ করতে করতে সে  তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। দৃষ্টিতে শূন্যতা। 
পরের দোকানের  শাটার পড়ে গেল। রাতে ম্যাটাডোরে  চড়ে কলা এসে ভর্তি করে দোকান। রাস্তাও ভরে ওঠে চিৎকারে।  অবশ্য রনিতার মনে  হয় সেটা চিৎকার। ওদের কথাবার্তা। ক্লান্তি কাটানোর রসদ। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে এই হৈ হৈ। ভোর  থেকে ছোটা হাতি ও ভ্যানে করে কলা চলে যায় বিভিন্ন দোকানে। আবার প্রায় দুঘন্টা ধরে চলে  চেঁচামেচি। ভোরের ঘুমের বারোটা  বেজে যায়। লাগোয়া বাড়ির লোকগুলো যে কি করে সহ্য করে ভাবে রনিতা।  ওর তো তিনদিনেই মাথা ঝনঝন করছে।    আজকাল মাছবাজারও খুব একটা সশব্দ নয়। ‘কি দাদা, আজকাল এত কম আসছেন ?’ বা ‘নাতি হল, মিষ্টি কবে খাবো ?’  এই   জাতীয় কথাবার্তা তো প্রায় শোনাই যায় না। দর কষাকষি নেই। হলেও তা খুব নিচু স্বরে। মলের বাজার তো এক শব্দহীন বানিজ্য প্রবাহ। একটা হলুদ উদাসীনতা থাকে ক্রেতা বিক্রেতার মুখে। জ্বলে ওঠা চোখ নেই। খুশির ছটফট নেই। ওদের ছোটবেলার মত বাচ্চাদের মধ্যে পুজোর বাজারের আনন্দ নেই। এদিকটা তেমন নয়। জীবন এখানে সশব্দে বইছে।  ছোট থেকে খুব নির্জনে বড় হওয়ায় রনিতা খুব একটা  হৈচৈ নিতে পারে না। 
  মেয়ে নতুন চাকরি পেয়েছে। কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকার জন্যই কোলকাতার এই অঞ্চলে ভাড়াবাড়ির  ব্যবস্থা।  একদম  রাস্তার উপর। তিনতলার ফ্ল্যাট। আলো হাওয়ায় ভর্তি। হেমন্তের রোদ্দুর সারাদিন ঘরে খেলে বেড়ায়।  রনিতা মেয়ের ফ্ল্যাট একটু গুছিয়ে দিতে এসেছে। মেয়ে সকালে বেরিয়ে রাতে বিধ্বস্ত হয়ে ঘরে ফেরে। ওভাবেই চালিয়ে নিচ্ছিল। মেয়েকে খুব আদরে   যত্নে, অন্যদের মত মানুষ করতে পারেনি রনিতা। ছোট থেকেই ওর সমবয়সী বাচ্চাদের মত স্বাভাবিক জীবন পায়নি মেয়ে।   স্বপ্ন আর বাস্তবের পার্থক্য বোঝার আগেই যে জীবন ওর ঘাড়ে চেপেছে তাকে বহন করতে শিখেছে। অনুভূতিকে চাপা দিতে  শিখেছে। কষ্টকে হজম করতে শিখেছে।  
এসব ভাবলে  রনিতার ভেতরটা হুহু করে। সঙ্গে সঙ্গে সে বেরিয়ে আসে সেই ভাবনা থেকে। আসলে পালায়। বিষাদ  বইতে পারে না। ক্রমাগত মন ফেরায়। ফেরায় সব না পারা থেকে। খারাপ থাকা থেকে। পুরনো মনস্তাপ থেকে। তার এই ফিরতে চাওয়া বড় তীব্র বলেই হয়তো ফিকে হতে হতে অতীতের অনেক কিছুই মুছে গেছে ওর মন থেকে। কত কিছুই তো মনে করতে পারে না আজকাল। 
বিকেলটা ভালোই কাটলো রনিতার।  পদ্মাবতী এসেছিল। সন্ধ্যে গড়িয়ে  আড্ডাটা বেশ চনমনে  হয়ে উঠেছিল। ওর  আনা পেস্ট্রির স্নেহ নিতে নিতে  কত গসিপ গরম পকোড়া হয়ে উঠলো। প্রকাশ্যে এল কত সন্ধিসুত্র। পাশে অবশ্য আবহ সঙ্গীতের মত বাজছিল ‘রাম নারায়ন রাম’ । পাশে ক্লাবের আয়োজনে  দুদিন ধরেই মাইক সহযোগে বাজছিল। পদ্মাবতী চলে গেল । মেয়ে ফিরে এল। অন্ধকার গাঢ় হতেই এ পাড়া যেন জেগে ওঠে। কাজ শেষে  মেয়েরা দলে দলে ফিরে আসে তাদের ভাড়াকরা ঘরে।  প্রায় সবার হাতেই অল্প স্বল্প বাজার।  রনিতার ভেতর থেকে একটা ‘আহা’ উঠে  আসে।  ভালোও লাগে একথা ভেবে যে কত ছোট থেকেই এরা স্বাবলম্বী। কাজে, বোধে, চিন্তায়।  কোন  নির্ভরতা নেই।  এই বয়সে রনিতা যা ভাবতেই পারতো না। দায়িত্বে অবহেলা রনিতার একেবারে অপছন্দের। তবে নেতৃত্বের বাসনা বা পারদর্শীতা কোনটাই তার ছিল না। এখনও নেই।  তবে  এসবের কোনটারই কমতি নেই প্রমিতের। 
গন্ধটা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে। ফ্ল্যাটের নিচতলায় মাংসের দোকান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিক্রি চলে। ব্যালকনির দরজা খুললেই গা গুলিয়ে আসে। ভাড়া থাকতে এসে এসব নিয়ে কিছু বলার নেই। এ নাকি দশ বছরের  দোকান। কাজেই গন্ধটা থাকছে। ফোড়নগন্ধে মিশে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে, ডিওডেরেন্টে, ঠাকুরের গাঁদা ফুলের মালায়। স্মৃতি বিস্মৃতির টানাপোড়েনে, মানিয়ে নেবার ব্যকরণে মাংসগন্ধ যেন জাগিয়ে রাখছে। যেন এক অন্য অবনী  অনবরত বিড়বিড় করে চলেছে, ‘বাড়ি আছো ? বাড়ি আছো ?’ বুড়োটা দোকানের সামনের চাতালে কাপড় কাচছে।  রং হারানো টিশার্টের কলারে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে চেঁচাচ্ছে, ‘দূর হ  মুখ্যু মাগি, বুঝিস কিছু ?’ বুড়ি টাকা গুনতে গুনতে বেরিয়ে  এল। ‘আমি বুঝি না, না ? এইতো একশো টাকা কম।’ পাশে   ‘ওকে টেলারিং’ এর মালিক কাপড়ের  টুকরো দিয়ে জুতো মুছছিল। ‘দ্যাখ তো অজিত, চাউমিন দিলো না, টাকাটা রেখে দিল।    বললো বিকেলে অন্য মালের সাথে দিয়ে দেবে। তা ও মাগি কিছুতেই বোঝে না।’ অজিত কি বুঝলো  বোঝা গেল না। বুড়ি গজগজ করতে করতে চলে গেল। রনিতার বেশ মজা লাগছে ওদের দেখতে। কি করবে সারাদিন একা একা থাকা। এইসব  দৃশ্য থেকে উঠে আসা গল্পেরাই ওকে ব্যস্ত রাখছে। বুড়ি আবার বেরিয়ে এল।  ‘কাপড় কাচতে কে বলেছে ? রান্না হবে তবে তো  কাচবো।’ ‘উ, বাতের ব্যতায় নড়তে পারে না ও মাগি আবার কাপড় কাচবে।  যা, দূর হ।’ রনিতার ডি, এল রায়ের ‘বুড়োবুড়ি’ কবিতাটা মনে পড়লো।  ‘হত যখন ঝগড়াঝাটি, হত প্রায়ই লাঠালাঠি/ ব্যাপার দেখে ছুটোছুটি, পাড়ার লোকে পুলিশ ডাকতো/  বুড়োবুড়ি দুজনাতে মনের মিলে সুখে থাকতো’।   
চল্লিশ পেরিয়ে যেতেই মনের মিল, সুখে থাকা এসব বোধ অন্যভাবে সঙ্ঘায়িত হয়েছে। আবার কিছু বোধ অস্পষ্ট। না  বোঝা  ব্যঞ্জনার মত লেপ্টে আছে ভাবনার স্পষ্টতায়। কুড়ি বছরের একটা অধ্যায় শেষ করে রনিতার এখন ছ’বছরের নতুন জীবন। সমমনস্ক মানুষ প্রমিতের সঙ্গে পছন্দের যাপন। প্রমিতের প্রচেষ্টায় ওর মেয়ের ম্যানেজমেন্ট পড়া এবং চাকরি। রনিতা এখন ওর সমস্ত ভার প্রমিতের উপর ছেড়ে বসে আছে। এখন ওর শুধু বর্তমান আছে।  পিছু হটতে হটতে অতীত অনেক পেছনে। রনিতার মনে হয় এটাই ওর সম্পূর্ণ জীবন। আর অন্য কিছু ছিলই না। একটা দীর্ঘ সাঁতারের দাগ শুধু মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে। তখন মনে হয় সে এতো কিছু পেরেছে ?  এসব মনে পড়লেই পালিয়ে আসে রনিতা। মনকে বসিয়ে দেয় অন্য আয়নার সামনে।  চোখও দেখে অন্য কিছু। এই যেমন এখন সে মন দিয়ে দেখছে, বাড়ির সামনের ছাদে এগারো বারো বছরের একটা মেয়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে একা একা বিড়বিড় করছে। গায়ের রং মেঘলা। ঠিক কালো নয়। হাতে একটা পুতুল। মেয়েটার চোখ থেকে ছিটকে যাচ্ছে আলো। একবার দাঁড়াচ্ছে, একবার বসছে।  ওড়নাটা কখনও মাথার লম্বা চুল হয়ে যাচ্ছে, কখনও আঁচল।  পুতুলকে মুখের কাছে এনে সে কত কথা বলছে।  রনিতা কিছু শুনতে পাচ্ছে না, তবে ওর কথার স্রোত ভিজিয়ে দিচ্ছে। ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাথায় গামছা বাঁধা পুতুল খেলার দিনে। এখন তো এ দৃশ্য দেখাই যায় না। একলা মেয়ের বালিকা বয়স ঢুকে যাচ্ছে রনিতার মধ্যে। খুব চেনা খুব নরম এই দৃশ্য এতদিন কোথায় লুকোনো ছিল ? মেয়ের শৈশবেও তো ফিরে আসে নি এইসব  নিভৃত আলো ? তবে কি সব জীবনের দামী মুহূর্তগুলো আসলে অজ্ঞাতবাসেই থাকে। তাকে চিনে নিতে হয় ? একটা ছটফটে  খুশী রনিতার মধ্যে টানটান উঠে দাঁড়ায়।  খুশিটা আরও তীব্র হয় রাত সাড়ে নটায়। রনিতা হঠাৎ শোনে,  ‘রিমি দি ধাপ্পা। এবার তুমি চোর। রনিতা ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে ছাদের সেই মেয়েটির সঙ্গে আরও দু তিন জন ছেলে মেয়ে লুকোচুরি খেলছে।  সাইকেল সারানোর দোকান, টেলারিং শপ,  বুড়োবুড়ির মুদিখানা, মাংসের দোকান ওদের সঙ্গে খেলছে। রনিতা অবাক হয়ে মেয়েকে বললো, দ্যাখ ওরা এত রাতে কেমন রাস্তায় লুকোচুরি খেলছে।’  মেয়ে জানলা দিয়ে একটু মুখ বাড়িয়ে দেখে বললো, ‘ও, ওরা তো প্রায়ই খেলে। এখনকার লোক তো বেশির ভাগ সময় রাস্তাতেই থাকে দেখছ তো। বস্তি কালচারটা এখনও যায়নি।’ রনিতা একটু চুপসে যায়।  মেয়ে ওর অনুভুতির জায়গাটা ধরতে পারেনি বলে একটু কষ্টও পায়।  আবার  ভাবে ওর মত এতো সামান্য ঘটনায় আলোড়িত হবার বয়স  হয়তো মেয়ের আসেনি। এছাড়া সেও কি মেয়েকে এমন একটা সত্যিকারের ছোটবেলা দিতে পেরেছে ? সে কি এত রাতে মেয়েকে রাস্তায় খেলার জন্য ছাড়তে পারতো ? রনিতা তাই তার বর্তমানে ফিরে আসে। মেয়েকে খেতে দেয়। অফিসের  গল্প শোনে। কর্পোরেট দুনিয়ার কত প্যাকেজিং ও খোলসের  কথা জানে। ওর না জানারা অপ্রত্যাশিত উপহার পাওয়ার মত বিস্ময়ে চুপ করে যায়।  
প্রতিটি সাঁতারই কিছু খড়কুটো পায়। খানিকটা আশ্রয় তার শ্রম কমিয়ে দেয়। কেউ কেউ থাকে যাদের তাগিদে বা ইচ্ছেশক্তির জোরেই ভেসে আসে খড়কুটো। রনিতা তেমনই  মানুষ। যন্ত্রণাকে নিতে নিতেই অন্য কোন নিরাময়কে ধরে  ফেলে। ক্ষতকে টিপের মত সাজিয়ে নেয় আর অতিক্রমের পরের কথা ভাবে।  যেমন করে স্কুল কলেজের পরীক্ষা চালাকালিন ভাবতো এই তো পাঁচ বা সাত তারিখেই শেষ। তারপর ও  কি স্বস্তি। সেটা ভাবতে ভাবতেই পরীক্ষার চাপ কেমন কমে  যেতো। এই যে এখন ডিপ্রেশন শব্দটা কেমন সব স্তরের মানুষের কাছে কমন হয়ে গেছে। অনেকে তো ‘আমি এখন ডিপ্রেশনে আছি’ বলতে বেশ ভালবাসে। এসব দেখে রনিতার মনে হয়, এটাও কি তবে আধুনিকতার অংশ  হয়ে যাচ্ছে।  দুঃখবিলাস কি মানুষের নরম মনের পরিচয় দেয় ?  রনিতার মা বলেছিল, ‘কি করে যে এতো স্বাভাবিক থাকিস বুঝিনা।‘ সংসার ভাঙার জন্য হা হুতাশ নেই। লোকে কি বলছে ভেবে সিঁটিয়ে থাকা নেই। কাল কি হবে ভাবনা নেই। ডিভোর্সি মায়ের মেয়ের বিয়ে হবে না সে ভয় নেই। তাহলে আর কি থাকলো ? কিছু তো থাকা উচিৎ। আসলে যা থেকেছিল তা হল রনিতার নিরাসক্তি। কি থেকে ? না, ওইসব ভাবনা থেকে। দুর্ভাবনায় যে তার বড় ভয়। ভয়ের বীজ মনের মাটিতে পড়তেই সে বসত বদলে ফেলে। এমনকি  নিজেকে প্রশ্ন করতেও পারে না। আত্মবীক্ষণ থেকে  জন্ম নেয় সমীক্ষা। আর সেই আত্মসমীক্ষা থেকে সরে যায় কাজের অভ্যেসে। এক অভ্যেস জন্ম দেয় অন্য অভ্যেসের। এভাবেই তো চলেছে এতগুলো বছর।  ‘এই বেশ ভালো আছি’। একদিন দেখিয়ে দিয়েছিল তার গোপন ড্রয়ার।  তখন প্রথম প্রেম আর নীলাঞ্জনা দিন। সুগন্ধে বসবাস। পরিবারে তখন বিধবা পিসি বা বেকার কাকারা নেই। বাবা জ্যাঠা দু’ভাইয়ের সংসার। রনিতারা দু ভাই বোন আর জেঠুর এক ছেলে। সে ব্যাঙ্গালরে পড়তো। বাড়িতে বড়দের বেশ কড়া শাসন।  নির্জনতা বেশ জমাট বেঁধে থাকতো। বাড়িতে কাজ করতো পূর্ণিমা। রনিতারই বয়সী। একটু বোকা সোকা। ওর ফর্সা গোল মুখ দেখে  জেঠিমা বলতো ‘তোর নামটা কিন্তু একেবারে ঠিক দিয়েছিল তোর দিদিমা’,  হিহি করে হাসতো পূর্ণিমা।  খুব খেতে  ভালোবাসতো। ‘দ্যাখো, আমি বাড়ছি মাম্মি’ বলার মত ওর কেউ ছিল না। তবে ওর শরীর বাড়ছিল বেশ হৈ হৈ করে।  রনিতার পুরনো জামাকাপড় ধরে রাখতে পারছিল না ওর শরীর। রনিতার মা আর বম্মা আড়ালে বলতো ‘মাথায় তো কোন বুদ্ধি নেই বিপদে না পড়ে মেয়েটা।  তারপর থাকে তো বস্তিতে। কত খারাপ লোকের বাস।’ সন্ধ্যের আগেই ওকে রাতের খাবার দিয়ে  বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হত। যাবার আগে রোজ এক কথা বলা হত, ‘সোজা বাড়ি চলে যাবি। কেউ ডাকলে যাবিনা।’
সেই দুপুরে পূর্ণিমা তো বাড়িতেই ছিল। রনিতার মা জেঠিমা সিনেমায়। ছুটির  দিন। বাবা ও ভাই  দুপুরের ঘুমে।  রনিতার দুপুর  জুড়ে চিঠি, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সাইকেল আর কি যেসব লাল নীল রোমাঞ্চ। বিছানায় গড়াতে গড়াতে, ডায়রিতে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে রনিতা উঠে গিয়েছিল জল খেতে। পূর্ণিমাকে খুঁজেছিল গোটা বাড়ি। ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব ছিল যে রনিতার উপর।  জেঠূর ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমাকে দেখেছিল রনিতা। জেঠুর বিছানায় বসে মাটির ভাঁড় থেকে গপগপ করে  মাংস খাচ্ছে। ওর জামার সব বোতাম খোলা।  ফ্রকটা গুটানো। প্যান্ট নেই। জেঠুর হাত ওর সারা শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পূর্ণিমার  যেন কোন হুঁশ নেই। মাঝে মাঝে ওর মুখ থেকে ‘উ, লাগছে’ বেরিয়ে আসছে। জেঠু বলছে ‘খা খা, তুই তো মাংস খেতে  ভালোবাসিস। আমি তোর জন্যই এনেছি।’ পূর্ণিমা আঙুল চাটছে। মাটির ভাঁড় থেকে জিভ দিয়ে শুষে নিচ্ছে রগরগে ঝোলের  স্বাদ, আর জেঠু উন্মাদের মত চটকে যাচ্ছে ওর ভরন্ত শরীর। এ যেন অন্য কেউ। রনিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া প্রিয় জেঠু নয়। এ কাকে দেখছে ?  ভয় আর বিস্ময় নিয়ে ঘরে ফিরে গিয়েছিল। চিনেছিল মা, বম্মার আশঙ্কাকে। ওর সুগন্ধে মিশে  গিয়েছিল অন্য এক অচেনা গন্ধ। কাউকে বলতে না পারা দৃশ্যটা থেকে একসময় সে সরে আসতে পেরেছে।  কিছু দাগছোপ কিছু আঁচড় মিশে গেছে বোধের সাদায়। কোন এক অদৃশ্য শক্তি নিজেকে উপড়ে আনার শিক্ষা দিয়েছে। গা ঢাকা দিতে দিতেও একটা খচখচ যে মাঝে মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারেনি তা নয়। তবে ঘরে বিশ্ব দেখার বিশ্বাস প্রতিবারই ওকে এক অন্য উত্তরণে পৌঁছে দিয়েছে।     
  তবে এই রনিতা বিকেলে চার দেয়ালের মধ্যে থাকতে পারেনা। শেষ আলোটুকু  শুষে নিতে না পারলে সন্ধ্যেটা থমথমে হয়ে থাকে। অচেনা পরিবেশ। ফ্ল্যাটের অন্যান্য লোকজনের সঙ্গেও আলাপ নেই। সে একটু সংশয় নিয়েই ছাদে উঠলো।  ছাদের দরজা খোলাই ছিল। চৌকো ছাদ। পাশের বাড়ির নারকেল গাছের পাতা ঝুঁকে পড়েছে ছাদের মেঝেয়। একধারে স্তুপ করা আবর্জনা।  তার মধ্যে  একটা নয়নতারা গাছ সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে নস্যাৎ করে ফুলে  ফুলে ভরে আছে। রনিতার ভেতরের খুশিটা আবার বড় হতে থাকে। হঠাৎ ওর চোখ যায় উল্টো দিকের দেয়ালে। দেয়ালে ঠেস দেওয়া আছে একটা নীল লেডিস সাইকেল। খুব পুরনো নয়।  নীল রঙটা বেশ গাঢ়।  একটা সময় হুড়মুড় করে রনিতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। খুশিটা লম্বা হতে হতে আকাশের নীলে মিশে যাচ্ছে। শুভমের সঙ্গে রনিতাকে পার্কে দেখে ফেলায় বাবা চিলেকোঠায় বন্ধ করে দিয়েছিল রনিতার  সাইকেল।  দীর্ঘদিন তালাবন্ধ বাড়িটার চিলেকোঠায় সমস্ত অভিমান নিয়ে পড়ে আছে ওর নীল সাইকেল, যার সারা গায়ে শুভমের ছোঁয়া । হঠাৎ তীব্র মাংসের গন্ধ রনিতাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। কিন্তু খুশিটা পড়তে পড়তে আবারও ধরে ফেললো মাটির ডালপালা। বুড়োটা চেঁচাচ্ছে, ‘মাগি, তোর বড্ড নোলা।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন