বেহুলা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
বিশাল বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বেহুলা । গদাই বলে – অমন ড্যাবড্যাব করে কি দেখছিস ? ভিতরে চল ।
‘ইয়া বড় ঘর , লোকজন নাই ?’
- সবই কপাল রে বেহুলা । একসময়ের রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি । লোক লস্করে ভরে থাকত । আজ খাঁ খাঁ করছে । দেখার কেউ নাই । এরেই বলে বিধাতার লিখন ।
থমথমে চারপাশ । ভাঙাচোরা পুরানো রাজবাড়ির আদল । নোনা দেওয়ালে লেখা অদৃশ্যলিপিগুলো দেখছিল বেহুলা ।কেউ যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।গদাইদা আসার সময় বারবার বলেছে ভয় পাসনে যেন । একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে বলিস ভজুখুড়া লোক ভালো ।মাত্তর দুটো লোকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা বললে ঠিক হয়ে যাবে ।বেতনও মন্দ লয় । টাকা পয়সার তো আর অভাব নেই লোকটার । অই যা ছন্নছাড়া অবস্থা ।বেহুলা দেখতে পাচ্ছিল কী যেন নেই বাড়িটায় । ছিরিছাঁদ । শুধু কি দেওয়াল আর উঠোন। সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে ।ছেলে দেখেনা । মেয়েও খবর নেয়না । শুধু পয়সা পয়সা , ধন দৌলত করতে গিয়ে ধ্বসে গেছে পুরো বাড়িটা ।
লম্বা উঠোন । চারদিকে ঘাস জমে আছে । মাঝে সরু সিঁথির পারা ক্ষীণ পায়ে চলা পথ ।সেই পথে পায়ে পায়ে হেঁটে আসতে আসতে গদাই বলে যাচ্ছিল – ‘গরীবের রক্ত চুষা পয়সা । বড় পাপের পয়সা রে বেহুলা । বন্ধকী কারবার , সুদের কারবার, দাদনের কারবার মানুষকে যেমন ফুলায় ফাঁপায় সেরকম একদিন সব রক্ত চুষেও লেয়।‘
নিজে
–‘সারাদিন করিস কি ? কেবল মরদলোকের সাথে ঢলানি । মাইরে হাড়গোড় ভাইঙ্গে দিব ।‘শুধু কথায় নয় কাজেও তা করে দেখাত হরেন তবু ভাব ভালোবাসার চেষ্টা করেছিল । কিন্তু লোকটার শরীরে ভাব সাব নেই । খালি ফুর্তির নেশা ।আটকাতে পারেনি তাকে। ভাব ভালোবাসা না হলেও কিছু তো আটকায় না।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল জুড়ে একটা ব্যাটা ছেলে এসেছিল । বেঁচে থাকলে জোয়ান বয়স হত এতদিনে । তার শোক ভুলতে পারেনি বেহুলা ।তিনদিনের জ্বরেই ছেলেটা কাহিল হয়ে গেল । হাসপাতালের ডাক্তারেরা বলেছিল – ডেঙ্গি । বড় দেরি করে ফেলেছ বেহুলা । দুদিন আগে এলেও চেষ্টা করতে পারতাম । এখন ভগবানই ভরসা । ভগবানের নাম জপ করতে করতে দুদিন আরও কাটল । কত মানত করল , কত মানসিক করল । বাবা সদাশিব ওদের গাঁয়ের জাগ্রত দেবতা তাকে কেঁদে কেঁদে কত ডাকল । তবু সদয় হলনা বুড়াবাবা । ছেলেটা নেতিয়ে যেতে লাগল ধীরে ধীরে । কোন সাড়াশব্দ নেই ।মরবার আগে মায়ের হাতটা জোর করে খামচে ধরেছিল বাচ্চাটা , কোনমতে ছাড়তে চায়নি । এখনও মনে হয় আরও দুদিন আগে যদি সে যেতে পারত ।
দরজার কড়া দুটো জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে গদাই বলল – ভজু খুড়া , দরজাটা খুল । দেখ কাকে লিয়ে এসেছি । কড়া নাড়ার তীব্র ধাতব শব্দে ভাবনটা ছিঁড়ে গেল বেহুলার ।
ভজহরি চক্কোতি মানুষ খুব ভালো । যেমন নরম মন তেমনি দয়ার শরীর । বেহুলাকে দেখেই বলল – তুমারে দেখে কেমন মায়া হয় গো । লক্ষ্মী পিতিমার মতন মুখ । চোখে টলটল করে দীঘি । খুব ভরসা হয় তুমারে দেখে । আজকাল তেমন বিশ্বাস করার মতন মানুষ আর কই । বেহুলার মনে হয়েছিল এত ধন দৌলত থাকা সত্ত্বেও লোকটার মুখে দুখের ছাপ । বেদনার কথা শুনতে পাচ্ছিল সে । যে ঘরটায় বসে তারা কথা বলছিল সেখানে ঠিকঠাক ঝাঁট পড়েনি কতদিন । ময়লার সর পড়েছে দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলির গায়ে । বেহুলার ইচ্ছে করছিল সব ময়লা ধুয়ে ঘরদোর ঝাঁ চকচকে করে দিতে ।
আপনি একলা থাকেন ?
মাথা নেড়ে ভজহরি বলল – একা মানে ? হ্যাঁ একাই। ছেলে বিদেশে থাকে বাপকে দেখার সময় কই তার । আজ চার বছর হয়ে গেল একবারের জন্যও দেখিনি তাকে ।চোখের মধ্যে এক অসাহায়তা লুকোতে পারছিল না গোবর্ধন ।
সেই মরে যাওয়া বাচ্চাটার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল বেহুলার । সেও কি বিদেশে ? কোন দেশ ? যেখান থেকে আর আসা যায় না । শুধু স্বপ্নের ভেতর হাত নাড়তে নাড়তে এসে সে তাকে ডাকত মাঝে মাঝে । নিশিডাকের মতো সেই ডাক বিহ্বল করে দিত বেহুলার শরীর । ঢেউ উঠত মনে । ঢেউ মিলিয়ে যেত ।ঘরের মানুষটার দিকে তাকিয়ে কেমন ঘেন্না হত বেহুলার । এই শোক তাকে ছুঁতে পারে নি । সবসময় সে একটা হাত খুঁজে বেড়াত । হরেনের ভরসা দেওয়া হাত । কিন্তু পেত না । বেপাড়ায় মদ আর গাঁজার আড্ডায় টইটম্বুর হয়ে থাকত সারাদিন । কান্না নদী হয়ে বইত বেহুলার চোখে । অভিমানগুলো তীরের ফলার মতন বেরিয়ে আসত এক এক সময় – তুমি আমার কন কম্মে লাগ শুনি । সারাদিন মদ মাইরে পইড়ে থাক। তাও জগান দিতে হয় আমাকে ।
-হারামজাদি , মদের খোটা দিবি না বইলে দিছি ।
-হিম্মত আছে ত নিজের পয়সায় খাও । আহা মিনসের মুরাদ কত আমার জানা আছে । দুপয়সা নাই ঝুলিতে লাফ পাইড়ছে কুলিতে ।
-মেলা বাজে বকিস না ত ।
-কি আমি বাজে বকছি ? তুমার জন্যিই আমার ছিলাট সাত সকালে চইলে গেল ।টাকা থাইকলে ওরে আমি ঠিক বড় হাসপাতালে লিয়ে যাইথম ।
- তাও বাইচত নাই । তুর লজর ট খুব খারাপ । তুই ডাইন আছিস বেহুলা ।
থরথর করে কেঁপে ওঠে বেহুলার পা তলের মাটি – ই কি বইলছ তুমি ?
আমি ঠিকই বলছি । তুর বিষ লজরে সারা শরীরে আমার জ্বলন হয় । ছিলাটার রক্ত খাইয়ে তুর খিদা মিটে নাই , লে ইবরে আমাকেও খা ।
সেদিনই এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিল বেহুলা । আর ফিরেও তাকায় নি হরেনের দিকে । তারপর বাপের বাড়ির ভাঙা চালাঘরে এসে উঠলে মা খেঁকিয়ে উঠেছিল –মিয়ালককে কত কিছু মাইনে লিতে হয় । ই ত সামান্য ব্যাপার । মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল রাগে । গলায় কলসি বেঁধে নদীর জলে ডুবে জীবনটাকে জলেই মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল বেহুলা । পারেনি । লখাই এসে টেনে তুলেছিল কয়েক ঢোক জল খাওয়া শরীর – ছিঃ , ইভাবে কেউ লিজেকে আধ বেলায় শেষ করে ।
-কি হবেক ই জীবন লিয়ে
-কত কিছুই ত শুরু হয় আবার লইতুন কইরে ।
-হয় না রে লখাই , পকায় খাওয়া ফুলে কি মালা হয় রে ।
- লদীর জল হইল গঙ্গা । গঙ্গায় ডুব দিলে সব শুদ্ধু হয় । আমি তোরে নাওয়ে চাপিয়ে দূর দেশে লিয়য়ে যাব । গাঁ ছাইড়ে ভিন গাঁয়ে ঘর বাঁইধব ।
নৌকা বাইত লখাই । পেশিবহুল হাতে নৌকার দাড় টানতে টানতে বলত – ই হাত ট ধর । জোর পাস ? মাথ নাড়ত বেহুলা । শুধু জোর ?আর কিছু নাই ?
ভরসাও জাগত মনে । নদীতে বান এলে শক্ত করে ধরে থাকত হাতটা – আরে ছাড় ছাড় , অনেকদূর যাইতে হবেক ।
তুই আমারে ডুবাই দিবিস না ত লখাই ।
লিজে ডুইবে মইরব । তবু তরে ডুইবতে দিব নাই ।
বালাই ষাট , অমন কথা মুখেও আইনতে নাই ।
অনেক পরে বেহুলা একদিন তাকিয়েছিল নদীর দিকে । এই নদীতেই ডুবে যেতে চেয়েছিল সে । জল ডুবায় , মরায় আবার ভালোবাসার ছলাতছল শব্দ হয়ে শস্যের আলপনা আঁকে ।না তার জীবনে শস্যের আলপনা আঁকতে পারেনি লখাই।অনেক অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও শূন্য ঘরে সেই বাচাটাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি বেহুলাও ।বুক টন টন করত মাঝে মাঝে । তবু মনে হত লখাই মানুষটাকে নিয়ে সে তো সুখেই আছে ।
কিন্তু সুখ তার কপালে নেই । কি যে একটা রোগ বাঁধাল লখাই । দিন দিন কেমন পুয়াল দড়ির মতন হয়ে যেতে লাগল তাগড়া গতর । অমন জুয়ান চেহারা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে এখন কঙ্কালের রূপ । ডাক্তার কী একটা ইংরিজি নাম বলেছিল অতসত মনে নেই বেহুলার । অনেক টাকা চাই । মাসে তিন চার হাজার টাকার ওষুধ ইঞ্জেকশন । তখনই সে গদাইকে ধরেছিল – আমারে একট কাজ দিতে পার গদাইদা।
তুই আবার কি কাজ করবি ?
যে কোন কাজ । রান্নাবানার কাজ থেকে জুতো সেলাই সব পারি । আমার শুধু পয়সা দরকার ।
ঘরের সব কথা খুলে বলেছিল গদাইকে । লখাইএর অসুস্থতার খুঁটিনাটি ।মানুষটা বড় ভালোবাসে গো দাদা ।জীবন ত আমারে কিছু দেয় নাই । শুধু এই একখানি চেরাগ ছাড়া ।
গদাই আশ্বাস দিতে পারেনি সেদিন – বলেছিল ঠিক আছে , আমি খবর দিব।
দেব দেব করেও অনেকদিন কেটে গেছে । বার কয়েক তাগাদা দিয়েছে বেহুলা । গদাইএর মনে পড়েছিল ভজহরি চক্কোত্তির কথা ।টাকা পয়সার তো অভাব নেই । জমি জায়গাও দেদার । লোকটাকে দেখার কেউ নেই । সদ্য বউ মারা যাওয়ায় ছন্নছাড়া অবস্থা তখন তার ।পাগলের মতন ঘুরে বেড়ায় , কোনদিন খায় , কোনদিন হয়তো সারাদিন খাওয়ার ইচ্ছেই জাগে না । কথাটা বেহুলার কাছে পাড়ব পাড়ব করেও মনের ভেতর পুষে রেখেছিল গদাই । তারপর একদিন দেখা হতেই বলেছিল - ভজুখুড়ার একজন কেয়ারটেকার দরকার তুই কি রাজি আছিস বেহুলা ? কেয়ারটেকার শব্দটার মানে বোঝেনি বেহুলা । সে হ্যা না কি বলবে বুঝতে পারছিল না । থতমত খেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ।গদাই ওকে আশ্বস্ত করেছিল- ঘাবড়াচ্ছিস কেন ? তেমন কিছু রাজকাজ নয় । বলতে গেলে কোন কাজই নয় । শুধু মানুষটাকে দেখা । আর টুকটাক বরাত শুনা ।
তাও কি কি করতে হবে শুনি ?
তেমন কিছুই নয় । ওর তো কাজকম্ম করার লোকের অভাব নেই । কত কামিন মুনিষ দুবেলা খাটছে । তুই শুধু মানুষটার একটু যত্ন করবি ।
-যত্ন !
-হ্যা । এতে আখেরে তোরই লাভ । মাস গেলে হাজার পাঁচেক পাবি । তোরও একটা হিল্লে হবে ।
কথাটা মন্দ বলেনি গদাই মোহন্ত । বেহুলা সাতপাঁচ ভেবে দেখেছিল পাঁচ হাজার টাকা আজকের দিনেও খুব কম অঙ্কের টাকা নয় । এতে লখাইএর অসুধ পত্তরের ব্যবস্থা তো করা যাবে । গদাইএর প্রস্তাব তাই এককথায় লুফে নিয়েছিল বেহুলা – চল না গো গদাইদা । আজই ফাইলেন কথা বইলে আসি ।
ফাইলেন মানে ফাইন্যাল । গদাই গড়িমসি করে বলেছিল – আজই যাবি ? দুদিন ভাইবে দেখ ।
আমার অত ভাবাভাবি নাই হবেক । চল আজই যাই ।
গদাই বলেছিল – যাবি যখন বলছিস তখন চল । আজ বেস্পতিবার কাশিপুরের হাটে যাব ভাইবেছিলাম একটা ছাগল কিনতে । সামনেই মনসাপুজা ।
মনসাপুজা ত এখন বহুত দেরি , লাও পরের হাটে যাবে তখন ।
বেহুলার কথা আর ঠেলে দিতে পারেনি গদাই । তাছাড়া ভজহরি চক্কোতিও সেই কবে থেকে বলে রেখেছে – একটা লিঝঞ্ঝাট কাজের লোক দেখে দিস বাপ । কোন পিছুটান নেই এমন মেয়েছেলে হলেই ভালো । দরদ দিয়ে সংসারটা দেখবে । যত্ন করে রেঁধে খাওয়াবে । ঘরটার ছিরি ফিরবে । বউ চলে গিয়ে আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে দেখতেই তো পাচ্ছ । ছেলে মেয়েরাও বিদেশ বিভূঁইএ থাকে । দু বছরেও আসার ফুরসত হয় না ।
নির্ঝঞ্ঝাট বলতে যা বোঝায় বেহুলা তা নয় বরং তার ঝামেলা অনেক বেশি। তবু সবকিছু শুনে ভজহরির ভাল লেগে গেল । এর মধ্যেই চা এসে গিয়েছিল সঙ্গে বিস্কুট । বেহুলা বলল – চায়ের কি দরকার ছিল এত কষ্ট করে । বললে আমিই বানিয়ে দিতাম ।
বিস্কুটে কামড় বসিয়ে ভজহরি বলল – সে দায়িত্বই তো এবার থেকে তোমার । আজ কিন্তু অতিথি । তাই যৎসামান্য আতিথয়তা ।
লোকটার দিলটা খুব বড় , বেহুলার মনে হল । আর হবে নাই বা কেন কত বড় ঘরের মানুষ । লোকের মুখে শুনেছে এক সময় একান্নটা পাতা পড়ত উঠোনে । ভিখারি লাগারি যারা আসত তারাও না খেয়ে ফিরে যেত না । সেই ঘরের মানুষ তার দিল কি আর পাঁচপ্যাচি মানুষের মতন হবে । পায়ে হাত দিয়ে লোকটাকে একটা পেন্নাম করার মন করেছিল বেহুলার । কিন্তু সাহস হয়নি । কত বড় মানুষ ।
কবে আসব কাজে ।
কাজে আসার আগে মাইনেপত্তর ঠিক করে নাও
সে ত গদাইদা বলেছে ।
তাও তুমার মুখ থেকে শুনা দরকার ।
কত আর । এখনকার বাজার ত জানেন , জিনিস পত্রের যা দাম । পাঁচ হাজারের নীচে হয়না ।
আচ্ছা । তাই দেব । কেয়ার টেকারের কাজ কিন্তু খুব মন দিয়ে করতে হয় । পারবে তো ?
খুব পারব । ঘাড় নাড়ে বেহুলা ।
তাহলে আজ থেকেই শুরু করে দাও ।
ঘরের মানুষটাকে নিয়ে আসব না ?
পরে কোন একসময় গিয়ে আনলেই হয় ।
একবেলার কাজেই ঘরটার ছিরি ছাদ ফিরিয়ে দিল বেহুলা ।ঝরঝরে বাতাস বইছে এখন । দম আটকে যাওয়া গুমোট ভাবটা চলে গেছে । দিনের আলো মরে যাচ্ছিল । বেহুলা বলল – আজ চলি দাদাবাবু । লোকটা হয়তো উপাস করেই বসে থাকবে আমার জন্যি ।
২
অনেক বলে কয়েও লখাইএর জায়গা হয়নি বাবুবাড়িতে । সাফ বলে দিয়েছে – বেতন যা লিবি লে , আমার কনহ আপত্তি নাই , দুবেলার খাবারও লিয়ে যা কিন্তুক রুগী মানুষ তার বহুত ঝামেলা ঝঞ্ঝট আছে। বেহুলাও বুঝেছে । বাবু তো আর গাড্ডায় পড়েনি যে যা বলবে সব শুনতে হবে । কাজ সেরে সাঁঝের বেলা ঘরে ফিরলে সে দেখে মানুষটা গোগাচ্ছে ।
কাতরালে মানুষটাকে তখন আর চেনা যায়না । কাটা ছাগলের মতন ছটফট করে, আছাড়ি পিছাড়ি খায় । কেঁদে সারা পাড়া জাগায় বেহুলা – অগো আমার কি হল । মানুষটা বিছনার লে উইথতে লাইরছে । তুমরা আইস্য । মা মনসা গ , তুমি সব বিষ লিয়ে লাও ইয়ার শরীল থাইকে , তুমার পায়ে পড়ি মা ।
-কাঁদিস না , বেহুলা । আমার বেলা ফুরাই আইসছে । তর লাইগে বহুত দুখ হয় রে তকে পাইয়েই পাইলম নাই ।
-চুপ যা , অমন কথা বলিস না । আমি লিজের জীবন দিয়েও তুকে বাঁচাব ।
হাড় জিরজিরে চেহারার দিকে তাকিয়ে সে দেখে তাল পাতার মাদুরে লেপটে আছে লখাইয়ের শরীর । কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখে এখনও লিকপিক করছে লড়াকু আলো – আমি আবার নৌকা বাইতে পারব , বল ।
-পাইরবি । খুব পাইরবি । তুর নাওয়ে বইসে ভাদু গান গাইব আমি । তার লাইগেই ত ।
ত্যাবড়ানো গালে নেমে এসেছে তিন চার ফোটা চোখের জল । বেহুলা শাড়ির খুঁট দিয়ে আলতো করে মুছে দেয় দাগ – চল এখনই তুকে হাসপাতালে লিয়ে যাব , আবার ।
হাসপাতালের নাম শুনলেই মুখটা আরও শুকিয়ে যায় লখাইয়ের - বহুত যন্তনা হয় , মনে হয় আগুন জাইলে দিয়েছে আমার সারা গায়ে ।
হক । তবু লিয়ে যাব । তুকে বাইচতে হবেক ।
এই হাসপাতালে চিকিৎসার তেমন সুযোগ নেই । ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছে তুমি ঠাকুরপুকুর বা বোম্বে নিয়ে যাও ।খুব তাড়াতাড়ি । যত দেরি করবে তত প্রাণের আশা কম । আজ বাবুকে সব কথা খুলে বলতে হবে । পয়সার খুব দরকার তার ।
তাই সকাল সকাল চলে এসেছে কাজে । কথাটা কীভাবে পাড়বে খুঁজে পাচ্ছিল না সে । নিজের মনের ভেতর হাতড়ে যাচ্ছিল । তবু সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারছিল না । অথচ পয়াসার খুব দরকার তার । আগাম নিয়ে খেটে খুটে যেভাবেই হোক গতর খাটিয়ে শোধ করে দেবে সে । কিন্তু বাবু এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি । অন্যদিন সকাল সকাল উঠে গাছে জল দেয় । সুন্দর এক বাগান বানিয়ে নিয়েছে এই কদিনে ।
চা বানিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখল কোন সাড়াশব্দ নেই মানুষটার । থমকে দাঁড়াল বেহুলা । জানলা দিয়ে হালকা আলো আসছে ঘরে । সকালের মায়াবী আলোয় সবকিছু ঝাপসা এবং রহস্যময় লাগে – চা রাইখ্যে দিলম । বিছানার ভেতর থেকে শরীরটা নড়ে উঠল - আমার শরীর ভাল নাইরে । মাথায় যন্তনা হইচ্ছ্যে ।
হাত বুল্যায় দিব ।
দিবি । দে ...
বিছানায় ভজহরি । জ্বরে না কি অদ্ভুত এক আবেশে তার শরীর কাপছে । মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে টের পেল বেহুলা । শরীরে এক অদ্ভুত শিরশিরানি হচ্ছে । কতদিন এরকম হাতের পরশ পড়েনি । এক মেয়েলি গন্ধে ভরে আছে ঘর । জ্বর বাড়ছে না জ্বর নেমে যাচ্ছে গা থেকে ভজহরি বুঝতে পারেনা । নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে ঝরে পড়ছে । এক রহস্যভরা মৃদু বাস্প উঠেছে বেহুলার শরীরে । তার কোমল ভূখণ্ডের মধ্যে যতখানি কলা কুশলতা আছে সে তার সমস্ত অস্ত্র প্রয়োগ করবে আজ । সে প্রস্তুত হচ্ছে নৃত্যের ভঙ্গিমায় । মেলে দিচ্ছে মায়াবী বিভঙ্গে । আলো এসে এসে পড়ছে উপত্যকায় । অদ্ভুত নৃত্যে দুলে উঠছে স্তনবৃন্ত । এগিয়ে আসছে , এই তো এগিয়ে আসছে হাতটা এগিয়ে আসছে বেহুলার ভরন্ত বুকে মুগ্ধতার দৃষ্টি লাফিয়ে নামছে ।কোন প্রতিরোধের আগল দিতে পারছেনা বেহুলাও । তার জমি কেঁপে উঠছে । প্লাবন আসা নদীর মতো সে ভাসিয়ে দেয় সমস্ত উপকূল । কালনাগিনী সাপটা কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে বেহুলার এদিক ওদিক। সেই ছিদ্রপথ যা দিয়ে সে প্রবেশ করবে লোহার বাসর ঘরে । দীর্ঘশীত পেরিয়ে বসন্তের উত্তাপ পায় ভজহরি । খৈনি খাওয়া ঠোঁটে চঞ্চল হয়ে উঠে নিমেষে । কানায় কানায় ভর্তি নদী হয়ে যায় বেহুলা – নাও ভাসাও মাঝি , নাও ভাসাও ।
ভেসে যাচ্ছে সে ভেসে যাচ্ছে এক অলৌকিক পিচ্ছিলতায় । সাপটা হিস হিস শব্দে এগিয়ে আসছে গোপন ছিদ্রের দিকে ছোবলের পর ছোবল । এত জ্বালা এত আনন্দ সে গরলে । বিষ ঢালতে ঢালতে একসময় থেমে যায় সাপটা । বেহুলা জাঁতি ছুঁড়ে তাকে মারেনা, আশ্লেষে ভেসে যায় নৌকাবিহারে ।
তুই আমারে যে সুখ দিলি বেহুলা । আমি আমার সবকিছু তোকে দিলম ।
সবকিছু লয় , আমাকে খালি একলাখ টাকা দাও । আর বেশি কিছু চাইনা গ । মানুষটারে বাঁচাব আমি ।
৩
ঘরে ফিরে গিয়ে বেহুলা দেখে সব চীৎকার থেমে গেছে লখাইয়ের । কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে । সমস্ত আর্তনাদ সমস্ত নিস্ফল আওয়াজ সে হজম করে নিয়েছে একা । ফসলকাটা ফাঁকা মাঠের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে সারা ঘর ।
‘’এই দেখো তুমার জিয়নকাঠি ‘’। টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে বেহুলা বাতাসের দিকে ছুড়ে দেয় তারএকমাত্র স্বপ্ন । প্রতিধ্বনি হয়ে শব্দটা ফিরে আসে তার বুকে । তবু কোন আলোড়ন নেই , উথালপাথাল নেই । শূন্য কঙ্কালসার বুকের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বেহুলা –‘’ তুই আর কয়েকঘন্টা আমার লাইগ্যে দাঁড়াতে লারলি । এত তাড়া তুর । ‘’ বেহুলার গলায় আর কোন রা নেই । বোবা হয়ে গেছে সে ।
একসময় থেমে যায় বোবা হাহাকার । চোখের জল শুকিয়ে গেলেও ঘা শুকোয় না । সে বাবুর বাড়ি যায় আবার । ভজহরি খুশি হয় তাকে দেখে – কি করবি বল । যার যদিন ই দুনিয়ায় । জীবনের সুখ দুখ ত আমাদের হাতে লয় । বাঁচার লাইগ্যে কাজ ত কইরতেই হবেক ।
আমি আর কাজ করব নি বাবু ।
হতবাক হয়ে যায় ভজহরি –তবে আলি কেনে ?
-তুমার পয়সাটা দিতে । মানুষের সপুন দেইখাবার চইখ না থাইকল্যে বিজলিবাতি জ্বাইল্যে আর কি হবেক ।
লাখ টাকার বান্ডিলটা টেবিলে নামিয়ে রাখে বেহুলা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন