বিজয়া দশমীর গল্প

বিসর্জন 

প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ

দূরে মাঠের শেষ প্রান্তে কাশফুলের ঝোপের গায়ে ধোঁয়াশা জমাট বেঁধে আছে। সূর্যের মুখ ঢেকে আছে ধূসর মেঘে। সকাল হয়েও যেন হচ্ছে না। ঢাকের কঠিও কি আজ একটু দেরি করেই পড়বে ! আর যে তর সইছে না কোজাগরির। বারান্দার চালায় দাঁড়িয়ে দাঁতন করতে করতে কান খাড়া করে একদৃষ্টে আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে ছোট্টো মেয়ে কোজাগরি। আজ কি তবে আকাশেরও মুখ ভাড় ! হঠাৎ করেই ''মা মা '' করে ডাকতে ডাকতে ছুট্টে রান্না ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে অপর্ণার কাপড়ের আঁচল ধরে টানতে লাগল কোজাগরি। আজ একটু বেশিই ব্যস্ত অপর্ণা। মোচার ঘণ্ট, নারকেলের বড়া, পোনা মাছ, তেঁতুলের টকের আয়োজন চলছে সকাল সকাল। এর মধ্যেও মেয়ের ডাকে পেছন ফিরে মুখে স্ফিত হাসি বুলিয়ে কোজাগরিকে কোলে তুলে নিল সে ।
-- এখনও মুখ ধোওনি সোনা ?
কোজাগরি মায়ের গলা জড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখ উঁচু করে মা-কে বলে ---
-- মা, আকাশটা কেমন কালো হয়ে আছে দেখো ।
-- হ্যাঁ, বিকেলের দিকে বৃষ্টি নামতে পারে।
কোজাগরি মুখ কালো করে যেন অভিমানী সুরে বলে উঠল ---
--- তবে কী হবে ?
অপর্ণা তার শিশু-কন্যার সরল অভিমানী প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে বলল ---
--- কী আর হবে বলো !
মায়ের কথার ঢঙে কোজাগরি এবার বিরক্তিসহকারে বলল ---
-- বলোনা, শহর কি অনেক দূরে ?
অপর্ণা তার অবুঝ মেয়েকে আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে উত্তর দিল ---
-- হ্যাঁ সোনা, অনেক দূরে, ট্রেনে করে যেতে হয়।
কোজাগরি বিস্মিত মুখে চোখ গোল গোল করে বলে ---
-- ট্রে---নে...?
আচ্ছা, আমরা কখন যাব মা ?
-- এই তো বাবার জন্য সমস্ত রান্না শেষ হলেই চান করে বেড়োবো। তুমি মুখ হাত ধুয়ে নতুন জামাটা পরে নাও দেখি।
কোজাগরির মুখে এক স্নিগ্ধ উল্লাস ফুটে উঠল। সে ছুট্টে ঘরে যেতে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল। তার শিশু-মনে কীযেন ভেবে বলল ---
-- জান মা, ওপাড়ার টুপুর দিদির চারটে জামা, ওর বাবা মা...
মুখের কথা শেষ না হতেই অপর্ণা একটু ইতস্তত করে বলে উঠলো,
---''যা আর দেরি করিস না কোজা, মুখ ধুয়ে নে, বেড়োতে হবে তো, বাবা কতদিন দেখেননি বলতো তোকে !!''
বলেই, আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অপর্ণা ।

পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পেরিয়ে আজ দশমী। কতদিন পর আজ বাবাকে দেখবে কোজাগরি। হাতের কর গুনে গুনে শিশু মনে হিসাব করছে সে। বাবা তো শহরের বড় প্যান্ডেলের শিবঠাকুর সেজেছে। এটা ভেবেই অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে তার মধ্যে। বাবার দেওয়া নতুন জামাটা পরে গট গট করে যখন পুজো প্যান্ডেলে ঢুকবে, সবাই তার দিকেই তাকিয়ে থাকবে। এটা তো তার বাবারই পুজো। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে বাবাকে। সবাই বলবে শিবের লক্ষ্মী এসেছে দেখো। হঠাৎ করেই কর্কশ গলার আওয়াজে চমক ভাঙল কোজাগরির।
---''খাজা নেবে খাজা, দু'টাকায় খাজা,''
কোজাগরি কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে ভাবল , পুজোর সময় ট্রেনেও এত দোকান বসে ! তারপর কৌতূহলের সাথে মা'কে জিজ্ঞাসা করল ----
---''মা ট্রেনেও কি মেলা বসে ?''
অপর্ণা হেসে উত্তর দিল ---
-- না মা, এদের হকার বলে ।
-- হকার...! সেটাকী ?
-- এরা ট্রেনে খাবার দাবার, জিনিসপত্র বিক্রি করে ।
কোজাগরির কৌতূহলী চোখ আরো যেন কত প্রশ্ন খুঁজে বেড়াল...

ট্রেন এসে থামলো তাদের গন্তব্য স্টেশনে। অপর্ণা কোজাগরিকে নিয়ে নামলো এক আভিজাত্যপূর্ণ ঝকঝকে প্ল্যাটফর্মে । কত লোকের ভিড়, কত ব্যস্ততায় মোড়া চারিদিক। কোজাগরি যেন হারিয়ে যাচ্ছে ভিড়ে। মায়ের আঙুলটা শক্ত করে ধরে ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে কোনো একদিকে এগিয়ে চলেছে সে । অপর্ণা এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে কোজার হাত, আর এক হাতে সযত্নে স্বামীর জন্য খাবার নেওয়া একটা চার তাকের টিফিনকৌট । ভিড়ের ঠেলায় মাঝে মাঝে গড়িয়ে পড়ছে কিছুটা তেঁতুলের টক । এইভাবে আস্তে আস্তে ভিড় ঠেলে নামলো তারা সোজা রাস্তায় । নতুন শহর, ঝকঝকে তকতকে রাস্তা, বড় বড় বাড়ি । শহর সেজে উঠেছে পুজোর আমেজে। চারিদিকে কত দোকান-পাট, রঙবে রঙের জামা-কাপড়, বড় বড় প্যান্ডেল, কত আলো, কত রোশনাই, কত লোক, তাদের কত রঙ, কত বেলুন, হাঁ করে চারিদিক যেন গিলে নিচ্ছে ছোট্টো মেয়েটা । তার চোখে হাজার প্রশ্ন, কিন্তু মুখ দিয়ে কথা সরছে না আর ।

হাঁটতে হাঁটতে তারা এসে পৌঁছালো ননীতলা সার্বজনীন দুর্গামণ্ডপের সামনে। কী বিশাল প্যান্ডেল, একদম যেন রাজমহল ! তার গায়ে কত কারুকার্য, কত কাঁচ আর পুঁতির কাজ ।
এতক্ষনে অপর্ণা মেয়ের গালে সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলল ---
-- কোজা, এখানেই তোর বাবা আছেন ।
কোজাগরি একবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার অবাক বিস্ময়ের সাথে সামনের বিশাল প্যান্ডেলের দিকে তাকায়, তার বুকের ভেতর হঠাৎ করেই কেমন যেন একটা ভয় দানা বাঁধছে। তবে এবার তার মুখ দিয়ে কথা সরল, সে মৃদু স্বরে বলল ----
--- মা এই বড় প্যান্ডেলটা বাবার ?
মেয়ের সরল প্রশ্নে অপর্ণা স্নিগ্ধ হাসির সাথে উত্তর দিল ---
--- হ্যাঁ রে মা, এখানেই তোর বাবা স্ট্যাচু সেজেছেন ।
--- স্ট্যাচু ! সেটা কী মা ?
--- মানে, এখানেই তোর বাবা শিবঠাকুর সেজে দাঁড়িয়ে আছেন ।
ছোট্ট মেয়ে কোজার মুখে এতক্ষনে হাসি ফুটল।
--- তাই ? অনেক দিন বাবার আদর খাইনি, চলো বাবার কাছে যাই ।
অপর্ণা মেয়ের হাত টেনে ধরে বলল ---
--- না রে পাগলি, বাবা তো আদর করতে পারবে না । বাবার কথা বলা, নড়া চড়া করা যে নিষেধ । চুপ করে এক ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ।
--- আমি এসেছি তাও বাবা কথা বলবে না ?
--- না রে, এটাই তো বাবার কাজ, এটাই কাজের নিয়ম ।
--- তবে বাবা খাবে কী করে ?
--- সে ওরা ঠিক রাত্রে বেলা খেতে দেবে । চল এবার প্যান্ডেলের কাছে যাই ।

অপর্ণা কোজাগরির হাতটা শক্ত করে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চললো । ফোয়ারা, ফুলের নানান রকম টব পেরিয়ে প্যান্ডেলের প্রবেশ দ্বারের কাছে পৌঁছাতেই তারা দেখল এক জায়গায় ছোটো বড় বাচ্চাদের জটলা বাঁধা ভিড় । তারা সেদিকে না তাকিয়ে ঢুকে পড়ল প্যান্ডেলের ভেতর । কিন্তু কোথায় শিবের স্ট্যাচু !! ভেতরে তো বিজয়ার আয়জন চলছে তুমুল দমে । কত সন্দেশ, মিষ্টি, নতুন পোশাকের গন্ধ। অপর্ণার নিজেকে বড্ড বেশি বেমানান লাগতে শুরু করল এবার । হঠাৎ করে এটকু অন্যমনস্ক হয়ে সে যেন ভাবছে অনেক কিছু ... চমক ভাঙল কোজাগরির গলায় ''বাবা...'' চিৎকার শুনে। চমকে উঠল অপর্ণা । একি কোজা গেলো কোথায় ! '' কোথায় গেলি কোজা ?'' বলতে বলতে প্যান্ডেলের বাইরে ছুটে বেরিয়ে এল অপর্ণা ।

ভিড় অনেকটা কমেছে, পুজো কমিটির সিকিওরিটি গার্ড এসে সামলে নিয়েছে ভিড়টা। ভিড়ের ভেতর এবার শিবের স্ট্যাচু দেখা যাচ্ছে । তার ঠোঁটের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে কয়েক ফোঁটা রক্ত, আর পায়ের ওপর জড় করা কিছু ভারী ইঁট পাথর । কোজাগরি ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল ---
--- ''কী হয়েছে বাবা তোমার, কী হয়েছে বলো, কথা বলো বাবা...''
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল কোজা। অপর্ণারও চোখ ছল ছল করছে। সিকিওরিটি গার্ড এগিয়ে এসে বলল ---
---'' বাচ্চারা একটু খেলা করছিলো, আর কিছু না। তোমরাও এখন যাও, স্ট্যাচুকে বিরক্ত কোরোনা ।''
কোজাগরি কারো কোনো কথা না শুনে বাবাকে বার বার ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলো ---'' বাবা কথা বল, এই দেখো তোমার দেওয়া নতুন জামাটা পরেছি । কেমন দেখাচ্ছে আমায় ? ...বাবা কথা বল।''
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে বলতে লাগলো ---- ''বাবা বাড়ি চল...
বাবা বাড়ি চল...''

দ্বাদশী অবধি শিবের স্ট্যাচুকে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, তেমনি কথা হয়েছিল । তাই মেয়ের হাজার চিৎকারেও নিথর চোখ দিয়ে জল পড়া নিষেধ । স্ট্যাচুকে বিরক্ত করারও নিয়ম নেই, তাই পুজো কমিটির লোক এসে ছোট্টা কোজাকে জোর করে টানতে টানতে বাবার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলো । মণ্ডপের ভেতর বিজয়া দশমীর ঢাক বাজছে খুব জোরে । ঢাকের শব্দে হয়ত বাবার বুকের ভেতর থেকে চিৎকার করে ডাকা একাধিক বার ''কোজা'' ডাকটা কোজাগরি শুনতে পায়নি সেদিন, শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদে গেছে...

শহর সেজে উঠেছে বিসর্জনের উল্লাসে। বাজছে বিষাদী-সুর। তার আলো-রোশনাইয়ের চাকচিক্যে কখন যে সেদিনের সূর্যাস্ত হল তা ঠিক বোঝা যাইনি । কিন্তু কোজাগরির ঘরের আটচালার ওপর থেকে বিসর্জনের সূর্য আস্তে আস্তে ডুবে গেলো ।

1 টি মন্তব্য: