ফাঁদ
আশরাফুল মণ্ডল
কিছুকাল আগেও ছাদে ঘুঘু নামতো
কিশোর আমরা ফাঁদ পেতে রাখতাম
ঘুঘু নির্বিঘ্নে রোদে সেঁকা শস্য খুঁটতো
খিদের আগুন নিভলেই ফুড়ুৎ
অসহায় ফাঁদ তাকিয়ে থাকতো
ফ্যালফ্যাল
এখন ছাদ ভর্তি রোদ
ফাঁকা মরুভূমি
শস্য নেই কোনো
আমাদের চারপাশে ফাঁদের টিলা
ঘুঘু হয়ে দানাপানি খুঁজি
এদিকওদিক হলেই ফাঁদবন্দি
ফাঁদহীন ছাদ কোথায়
কে জানে
এই কবিতার জন্ম এক অলস দুপুরে। ছাদের নির্জনতায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঘুঘুর অভাব অনুভবে। মনে পড়ে গেল শৈশবের সেই সরল ফাঁদ। রোদে-রাঙা ছাদ আর ক্ষুধার সাদা পাখিরা। এক ঝলক হাওয়ার সঙ্গে মনে এলো পুরোনো দিনের ফাঁদ। ঘুঘু। ছেলেবেলা। যেন সেই ফাঁদ ছিল খেলার মতো! এখনকারগুলো জীবন-খেকো। শস্য ছিল। ছিল ছুটে যাওয়া পাখি।
এখন শুধু ফাঁদের মতো চারপাশ। নিরুপায়। নীরব। আমি নিজেই যেন ঘুঘু হয়ে গেছি! ফাঁদের দিকে পা বাড়াই!
এই কবিতা আসলে এক আর্তনাদ। পাখিদের নয়। মানুষের। ছাদ হারিয়েছে তার সরলতা। ফাঁদ পেয়েছে এখন গোপন জিভ। ঘুঘুর বদলে উড়ে যেতে চাই, আমরা এখন। কিন্তু কোথাও আর ফাঁদহীন আকাশ নেই।
আমি যখন ‘ফাঁদ’ কবিতাটি লিখি, তখন আমার মনের মধ্যে একটা সময়চক্র ঘুরছিল। একটা সময় ছিল। সেই সময়টা শৈশব-কৈশোর। যখন মনে কোনোও জটিলতা ছিল না। সরলতা ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে এক নিবিড় সহবাস ছিল। ছাদে ঘুঘু নামতো। আমরা ফাঁদ পেতে রাখতাম। সেটা ছিল একধরনের খেলা। একধরনের জীবনচর্চা। যেখানে ধরা-পড়ার ব্যঞ্জনা ছিল, কিন্তু নির্মমতা ছিল না।
এই কবিতার প্রথম স্তবকে আমি সেই অতীতকে ফিরিয়ে এনেছি। শব্দচয়ন করেছি খুব সচেতনভাবে। যেমন—“ঘুঘু”, “ফাঁদ”, “রোদ”, “শস্য”, “ফুড়ুৎ”, “ফ্যালফ্যাল”—এই শব্দগুলো বেছে নিয়েছি কারণ এদের মধ্যে একটা গ্রামীণ নস্টালজিয়া আছে। একটা শ্রুতিমধুরতা আছে। আর দৃশ্য নির্মাণেও সহায়ক হয়েছে।
"কিছুকাল আগেও ছাদে ঘুঘু নামতো"—এই লাইনটি দিয়ে আমি সময়কে টেনে আনি—“কিছুকাল আগেও” মানে অতীত খুব সুদূর নয়, অথচ তার সঙ্গে বর্তমানের এক ছেদ ঘটেছে।
“কিশোর আমরা ফাঁদ পেতে রাখতাম”—এই লাইনটা ‘আমরা’র মাধ্যমে গোষ্ঠীসত্তা নির্মাণ করতে চেয়েছি। যেন শুধু আমি নই, অনেকেই ছিল! এখানে সময়টা কৈশোর। জীবনের এক নিষ্কলুষ সময়।
আমি চাইনি অতীতকে রোমান্টিসাইজ করতে। কিন্তু একটা নরম আলো ফেলতে চেয়েছি। “ঘুঘু নির্বিঘ্নে রোদে সেঁকা শস্য খুঁটতো”—এই লাইনটি আমি গড়েছি যেন পাঠকের চোখে একটা দৃশ্য ফুটে ওঠে! শস্য খোঁজা, রোদে বসা প্রকৃতপক্ষে ঘুঘুর নিরাপত্তাবোধের অনুসঙ্গ। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ।
তবে ঠিক পরের ছত্রেই—“খিদের আগুন নিভলেই ফুড়ুৎ”—এই ‘ফুড়ুৎ’ শব্দটা আমি রেখেছি অনুকারধ্বনির জন্য। যেন শব্দের মধ্যেই একটা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আছে! খিদের আগুন নিভে গেলে সে উড়ে যায়। অথচ আমরা চাইতাম সে ধরা পড়ুক।
আর এরপরই যে চিত্রটি আমি দিতে চেয়েছি, তা হলো—“অসহায় ফাঁদ তাকিয়ে থাকতো / ফ্যালফ্যাল”। এই ‘ফাঁদ’ এখানে কেবল একটি বস্তু নয়। এ এক জীবন্ত অনুভূতি। সে তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে। ‘ফ্যালফ্যাল’ শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি ভাষার খেলায়। একটি চোখের ভাষা তৈরি করতে। যেন সে হেরে গেছে! যেন বঞ্চিত হয়েছে! এই স্তবকে শব্দের গঠন আর বাক্যের বিন্যাস সরল রেখেছি। যাতে কবিতাটি পড়বার সময় প্রিয় পাঠকের কোনো প্রতিবন্ধকতা না আসে। তবে সরলতা যেন শূন্যতা না হয়ে পড়ে, তাই ধ্বনিগত বিন্যাসে ছন্দ ও প্রতিধ্বনি রেখেছি।
“এখন ছাদ ভর্তি রোদ / ফাঁকা মরুভূমি”—এই দুটি পঙ্ক্তি দিয়েই আমি বর্তমানের অসাড়তাকে ধরতে চেয়েছি। রোদ আছে। ছাদ আছে। কিন্তু ঘুঘু নেই। শস্য নেই। ‘রোদ’ এখানে নিছক আলো নয়। এ হল একধরনের ক্লান্তি। একধরনের তাপ। যেখানে জীবনের প্রশান্তি নেই। আছে জ্বালা। আর ছাদ হয়ে উঠেছে এক ‘ফাঁকা মরুভূমি’। এই চিত্রকল্পটি আমি বেছে নিয়েছি নিঃসঙ্গতা, বন্ধ্যাত্ব এবং নৈঃসঙ্গের রূপ দিতে।
এরপরই আসে আমার কবিতার মোচড়—যেখানে আমি আমার পাঠককে হঠাৎ করে ঘুঘুর দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের দৃষ্টিকোণে সরিয়ে নিয়ে আসি। “আমাদের চারপাশে ফাঁদের টিলা”— এই ‘টিলা’ শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি প্রতীক হিসেবে। যেন ফাঁদ আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই! বরং তারা স্তূপ হয়ে গেছে! আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিপদ। কৌশল। শোষণ। দমন। প্রতারণা। এখানে সমাজের রূপক এসে পড়ে।
“ঘুঘু হয়ে দানাপানি খুঁজি / এদিকওদিক হলেই ফাঁদবন্দি”—এই দুই ছত্রে আমি নিজেকে এবং আমার সমকালীন মানুষদের ঘুঘু হিসেবে চিত্রিত করেছি। এখন আমরা সেই নিরীহ, ক্ষুধার্ত প্রাণী, যারা একটু শস্য খুঁজি। একটু শান্তি খুঁজি। একটু ভালোবাসা খুঁজি। কিন্তু আমাদের চারদিকে ফাঁদ যেন পেতে রাখা হয়েছে। যাতে আমরা বিপন্ন হই। আমাদের সমূহ প্রতিবেশে সর্বনাশা জাল ছড়ানো আছে। এক পা এদিকেই বা ওদিকেই হলেই ‘ফাঁদবন্দি’ হয়ে যাওয়ার ঘোরতর সম্ভাবনা। এই অংশটি মূলত আমাদের সমাজ-বাস্তবতার এক কঠোর চিত্র। আজ আমরা চাকরি খুঁজি, মর্যাদা খুঁজি, একটু শ্বাস নেওয়ার জায়গা খুঁজি— কিন্তু সর্বত্র ফাঁদ।
“ফাঁদহীন ছাদ কোথায় / কে জানে”—এই দুটি পঙ্ক্তি দিয়েই আমি কবিতার সমাপ্তি টানি, কিন্তু প্রশ্ন রেখে দিই। কোনো নিশ্চিত উত্তর নেই এখানে। আমি নিজেও জানি না কোথাও কি সত্যিই ‘ফাঁদহীন ছাদ’ আছে? যেখানে কেউ আমাদের দমিয়ে দেবে না? বাঁধবে না? কোনো শর্ত দেবে না? এ একধরনের নিঃসঙ্গ প্রশ্ন, যা পাঠকের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। এই জায়গায় এসে কবিতা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সমষ্টিগত চেতনার দিকে পৌঁছে যাক - এই আমার একান্ত প্রত্যাশা। আর আমি মনে করি এই প্রশ্নটিই কবিতার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রস্তাব।
এই কবিতার প্রধান রূপক হল—“ফাঁদ”। প্রথমে এই রূপকটি বাস্তব বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। প্রথমে এখানে ফাঁদ বলতে পাখি ধরার যন্ত্র বোঝাতে চেয়েছি। পরবর্তীতে এটি রূপান্তরিত হয়েছে সমাজের জালে। শোষণের কৌশলে। জীবনের এক অনিবার্য শৃঙ্খলে।
ঘুঘুও একটি রূপক। প্রথম স্তবকে সে শিকার। দ্বিতীয় স্তবকে সে আসলে তো এই আমরা সেই সমষ্টি - যারা নিরুপায়, ক্ষুধার্ত, আশ্রয়প্রার্থী।
এই কবিতায় আমি চিত্রকল্প নির্মাণ করেছি সংক্ষিপ্ত অথচ দৃশ্যমান শব্দ দিয়ে। যেমন ছাদে ঘুঘু নামা, ফাঁদ পেতে রাখা, শস্য খোঁজা, ফাঁকা মরুভূমির টিলা হয়ে থাকা ফাঁদ, ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকা। প্রত্যেকটি চিত্র যেন একেকটি দৃশ্যরূপ! যেন পাঠকের চোখে তা ভেসে ওঠে! আমি চেয়েছি শব্দ যেন ছন্দ ও ভাব দুটোই বহন করে। সেজন্য কোনো অলঙ্কার-বৈভবে কবিতাটিকে ভারাক্রান্ত করিনি। বরং জৈব ভাষা, সহজ বাক্যচিত্র, হালকা ধ্বনির প্রতিধ্বনি নির্মাণের চেষ্টা করেছি। ছোট ছোট বাক্যে আমি একটা ক্লান্তির অনুসঙ্গ এনেছি। যেমন : “ফাঁকা মরুভূমি," “ফাঁদহীন ছাদ কোথায়” ইত্যাদি। এসব বাক্য ছোট কিন্তু উচ্চারণে একটি দার্শনিক ভাব আছে। আমি চেয়েছি কবিতা যেন অর্থ ও অনুভব এই দু’পাশেই সমানভাবে ভর করে দাঁড়ায়।
কবিতা হিসাবে "ফাঁদ" কতটা সার্থক - এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। কারণ একবার লেখা হয়ে গেলে কবিতা পাঠকের সম্পত্তি হয়ে যায় বলেই জানি। তবু আমি বলতে পারি ‘ফাঁদ’ লেখার সময় আমি নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়েছিলাম। আমার কৈশোরের স্মৃতি, বর্তমানের বিষণ্ণতা, সমাজের জটিলতা, এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—এই সবকিছু একত্রে এনে কয়েকটি পঙ্ক্তিতে ধরতে চেয়েছি।
আমি চেয়েছি আমার পাঠক যেন এই কবিতাটি পড়ে নিজের জীবনের ছাদে ফিরে যান—যেখানে তিনি কোনোদিন ঘুঘু দেখেছিলেন, কিংবা আজ নিজেকেই ঘুঘু মনে করেন।
‘ফাঁদ’ আমার কাছে এক জীবনদর্শন। এক সামাজিক উপমা। এক নৈঃসঙ্গের আত্মকথন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন