দী নে শ ক র
একটি কবিতার প্রেক্ষাপট এবং পদধ্বনি
যখন ঠিক করলাম, বলা চলে অটুট সিদ্ধান্ত নিলাম,
প্রধানত কবিতা নিয়েই এই জীবন কাটাব, তারও আঠারো বছর পর
প্রকাশিত হ'ল আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
পৃথিবী ঘিরে কাজেই প্রথম সন্তান। দুই মলাটের ভেতর মুদ্রিত অক্ষরমালা।
তার ওঠানামা। আলো-অন্ধকার। আদর-আপ্যায়ন।
প্রথম পিতাজন্মের অনন্য অভিজ্ঞতায় কম্পমান ধরিত্রী।
আনন্দ-আচ্ছন্নতা। অনেকটা উন্মাদনাও। সংযমিত আবেগ
কোথাও কোথাও অসংযমী।
সর্বোপরি এতো এতো মানুষ এতো প্রবল উৎসাহে বইটি সংগ্রহ করলেন,
সামাজিক মাধ্যমে পত্র-পত্রিকায় মৌখিকভাবে সুবাতাসের মতো
পাঠপ্রতিক্রিয়া জানালেন যে,
স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধায় আমার মাথানীচু।
সব মিলিয়ে স্মরণীয় ঘোর। নিমজ্জিত চরাচর।
অনন্যোপায় সে-ইশারায় সাড়া দিতে আগ্রহী সমগ্র।
বই বেরোলো ঠিকই, বইটি থেকে আমি বেরোতে পারলাম না বহুদিন।
বিস্ময়ের হ’লেও (অথবা বিস্ময়ের কিছু নেই) সত্য এই,
আমার লেখালেখিতে অন্তরায় হ'য়ে দাঁড়াল
আমারই অন্তর-নির্গত আশ্চর্য বসুন্ধরা।
প্রাচীরের ভঙ্গিমায়। বারবার সেই কাব্যভাষা, শব্দচয়নের এক সীমাবদ্ধতা,
আরম্ভ-অন্তিমে একইরকম সূচনা-সমাপ্তি।
বৃত্ত-বৃত্ত। পরিধি জুড়ে ঘূর্ণন। নিস্তার নেই। চরম অস্থিরতায় আক্রান্ত ভুবন।
দীর্ঘকাল সুতরাং চুপচাপ। কাগজ-কলমের ছুটি।
কেবল পড়াশোনা। ঘোরাঘুরি। মাঝে মাঝে ধ্যানমগ্ন।
বিস্মরণের তপস্যা। সুনিবিড়। নিজেকে অনুসরণের পরিবর্তে
নিজেকেই অতিক্রমের অদম্য আকাঙ্ক্ষায়।
আরাধ্য সূর্যোদয়
ইতিমধ্যে কয়েকজন এমনি এসেছিল এমনি চলে গেল।
এসেছিল। কারণ, চারিত্রিক ঋজুতা। আদর্শের আকর্ষণ। অন্তত সাহিত্যচর্চায়।
ধর্মপ্রাণদের ধর্ম যেমন। নির্ধারিত দূরত্বেই তা শুধু অসাধারণ।
আরাধ্য সূর্যোদয়।
চলে গেল। যেহেতু তার সঙ্গে, আর যাইহোক, হাতে হাত হাঁটা যায় না।
প্রতিটি ঋতুকে রাঙানো যায় না হৃদয়-উত্থিত অনুরাগে।
ঘনিষ্ঠতা এক্ষেত্রে যন্ত্রণার সমনাম।
আকাশ ভেঙে পড়ল না তবু। বাতাস স্তব্ধ হ'ল না। উপর-উপর
এমনই মনে হবে। ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন নেই বিন্দুমাত্র।
অন্দরমহল আসলে তোলপাড়। উথাল-পাথাল ঢেউ সেখানে। সম্পর্ককে যে কবেই
স্থাপন করেছিল সে সুমহান উচ্চতায়। মানসিক মেলবন্ধনকে রেখেছিল
মন্ত্রের বিভায়। অন্য-অন্য অর্জনে চুরমার অবশেষে
এ-অর্জনের প্রতিমা।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে ছিল বন্ধুরও অতিরিক্ত।
অনিবার্যতায় আবার সেই অতীত। দশ অস্ত্রে আটকালো দশদিক। সংখ্য-অসংখ্য
রোদরাত্রিকে প্রেমিকা মেনে। কোনোখানে যাওয়ার নেই বুঝি।
ফেরারও নেই কোনোখানে।
এই আসা-যাওয়ার মাঝখানে অতএব একা-একা
আমার গোধূলি। পাখিদেরও বাসা আছে। প্রজাপতিরও আস্তানা।
জীবনানন্দের উচ্চারণ তখন আমারও উচ্চারণ,
‘কেউ নেই, কিছু নেই --- সূর্য নিভে গেছে’।
সমস্ত সুস্থির হ’তে হ’তে অঞ্জলি হ'তে খসে পড়লো অনেক সময়।
পরমায়ুর খণ্ডাংশ। অমানিশা শেষমেশ
পূর্ণিমায় রূপান্তরিত। এর তুলনা নেই। যথার্থ সমার্থক। পায়রা শান্তি হ'য়ে উড়ছে ওই।
যেন সবে শ্মশান হ'তে ফিরেছি। কারও জন্য কোনো
শোক সাজানো নেই। যে জুটবে তারই চারপাশে মেধা-মায়া-মোহ।
সাক্ষী নৈঃশব্দ্য
পুনর্জন্ম পুনরায়। জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ এইসব সংশয়-জিজ্ঞাসার পাহাড়
পেরোতে পেরোতে। শুক্রাণু-ডিম্বাণুর খেলা। সঙ্গম-অন্তিমে অভিনব উদ্ধার।
শিরোনামে লালন ফকির:
থাক না মন একান্ত হয়ে
চ.
টুকরো টুকরো পরিচয়ে যে-পৃথিবী, সেখানে সব চরিত্র তুলতে তুলতে
আরও আরও পৃথিবী। কারও মুখে আজন্মের তিল, কেউ ভুল বানানে
লিখেছে বিকেল। কাকে নেবে তবে, সংলাপ রাখবে কার ওষ্ঠে --- ভাবতে ভাবতে
চিরকাল অরক্ষিত দুয়ার। প্রবেশ শুধু সত্য। প্রস্থানের পিছু পিছু
কতো কতো ডালপালা। নিভন্ত প্রহর।
সেই থেকে নেওয়া নেই। যাচাইয়ের অন্ধকারে
যতটুকু আলো...
ছ.
দ্বিধায় শুধু নিজেকে দুলিও না। সে না-এলে অন্য, অন্য না-হলে অপর।
এবং বিন্যাস। ঠিক অবস্থানে সঠিক উপস্থিতি। জমানো ভোর। তোমার
আমার নিবেদন। বোঝাতে বোঝাতে সন্ধ্যা ফুরিয়ে এলো। এখন রাত্রি।
মুখোমুখি হও, সাক্ষী নৈঃশব্দ্য।
বলো, কী কী বলার ছিল। কী কী উপকরণকে পাঠক বলবে,
এ তো আমারই, প্রিয় গতজন্ম...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন