কবিতার হৃদয় খুঁড়ে পাঠক যখন তার মর্মোদ্ধার করেন তখন একজন কবি কি জানতে পারেন পাঠকের অনুভব! আমার অনন্ত প্রতীক্ষা সেই সব পাঠকদের জন্য। তাঁরা আমার কাছে ঈশ্বর। তাঁদের সমালোচনা আমার কাছে আশীর্বাদ।
পদ্য থেকে গদ্যে
ভজন দত্ত
“আকাশের অজস্র নীলখিদের পেটে গরম গরম ল্যাংচা এঁকে ঝুলিয়ে দিচ্ছো,
তোমার কারা!
সমাধিস্থলে এঁটোকাঁটার উল্লাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টুম্পা নাচে পিকনিক
সিটি মেরে সেল্ফি খিঁচে গেছে যারা, তারাই বা কারা!
ছেঁড়াদড়ির খাটিয়ায় শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে শুশনি শাক ও কলমিলতা
অনলাইনে কেনার জন্য জোরাজুরি করছে যারা, তারাই বা কারা!
কুরচি ফুল,শাল ফুল,পিয়াল ফল, সীতাপাতা লুঠ নিয়ে যারা সেমিনারে
পাত পেড়ে খেয়ে গেল, ওরা কি মানুষ! ওরা কি ভুখা!
মরানদী, ধুধু বালি, ফুটিফাটা মাটি দেখে যারা কুমিরের কান্না
গেয়ে গেল মশকরা রসে,তারা, তারা কারা!
কারা যেন বলেছিল 'টোনাটুনির সংসারে ছিটকানি! জরুরত কেয়া!' রামনাম
সত্য করে ওদের জলজমিজঙ্গল লুঠ করে 'পাল্লামেন্টে' পাল্লা ভারি করার কামড়াকামড়ি খেলা
খেলে যারা, তারা কারা!
২৪×৭ ফিরির নেট খাইয়ে বিশুদ্ধ অক্সিজেন হাহাকারের ব্যবসা সম্প্রসারণ
করতে যারা ঘুষের টাকার দালালি খেল,তারাই বা কারা!
মানুষ জন্মকথাকে যারা চির নষ্টকথায় বদলে মানুষে মানুষে ভিনু
করে দিল সেই ব্যাপারীদের বাড়তে দিল কারা!
এমত সকল বিস্ময় বিস্তারিত হলে কবিতা আর কবিতা থাকে না আনারকলি!
চলো, এবার পদ্য থেকে গদ্যের দিকে ছুটে চলো। মগজে শীত জমছে!
বিছানার এত রোদ খিদে বাড়ছে রোজ!
চলো, রোদ ধরাধরি করি শীতলতম দিনে, না হলে খেজুর গাছে চড়ে দেখো,পৃথিবীতে
রোদ ও নলেনগুড়ের কদর আজও তেমনি রয়েছে…”
নিজের কবিতা নিয়ে লেখা শোভনীয়, না কি কালবৈশাখী, সেই কথাটি জানেন মশাই সম্পাদক । এই যে কবিতাটি আপনাদের সমীপে রাখলাম এর জন্ম ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ, তিথি নক্ষত্র পাঠকের পাঠ সময়, এর জন্মস্থান জঙ্গলমহল। জঙ্গলমহলের বিস্তৃতি ধরতে গেলে পাঠককে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার প্রকৃতি, সাধারণ গরীব খেটেখাওয়া মানুষের যাপন, জীবনের কাছে এসে দাঁড়াতে হবে। সর্বোপরি, মনে রাখতে হবে সময়, যে সময় আমরা পার হয়ে চলেছি সেই সময়।সময়ের মার সহ্য করতেই হয়। এই সময়ে ভার্চুয়াল আনন্দ, শোক, রাগ, ঘৃণা,বিপ্লব নিয়ে আমরা যখন মাতামাতি করছি। সেই সময়কে ভুলে, মানুষকে ভুলে আমরা যখন উল্লাসে চরম ডুবতে ডুবতে দমবন্ধ হয়ে হাঁকপাঁক করছি, এই কবিতাটি সেই সময়ের কবিতা।
জঙ্গল মহল থেকে হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই, তবুও এখনো যা আছে তা হলো
গর্ব করার মতো উদার অকৃপন প্রকৃতি। প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়সূচক চিহ্নটি
আগে ভেবে নিন, তারপর পড়ুন,
“আকাশের অজস্র নীলখিদের পেটে গরম গরম ল্যাংচা এঁকে ঝুলিয়ে দিচ্ছো, তোমার কারা ”
আকাশে যতই নীল ভরে ঠেসে দিন না কেন, তার পেট ভরানো স্বয়ং স্রষ্টার পক্ষেও কি সম্ভব! বিস্ময় সূচক চিহ্নটিকে ল্যাংচা ধরলে এই পঙক্তিকে ধরা যায়। ল্যাংচা জঙ্গলমহলের এক জনপ্রিয় মিষ্টি। যা সাধারণত ‘বাবুঘরের’ ‘বিহাঘর’ কিংবা কোনো ভোজঘরের শেষ পাতে নিমন্ত্রিতদের পরিবেশন করা হয়। কিন্তু এখানে ‘নীলখিদে’ এই সমাসবদ্ধ শব্দটি দিয়ে আরেক খিদের কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। পৃথিবীতে পেটের নিচের খিদেও কি কিছু কম!
দ্বিতীয় প্যারাটি আরেকবার পড়ুন
“সমাধিস্থলে এঁটোকাঁটার উল্লাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টুম্পা নাচে পিকনিক সিটি মেরে সেল্ফি খিঁচে গেছে যারা, তারাই বা কারা! ”
যে জঙ্গলে আমাদের বাপদাদাদেরর স্মৃতি রয়ে গেছে সেখানে দেখবেন
পিকনিকের সময় নাগরিকদের উল্লাস। এখানে সেখানে মদের ভাঙা বোতলে নগ্নপদ হেঁটে গেলে পা
রক্তাক্ত হবেই । সেলফিস সেল্ফির এই পৃথিবীতে হরদম সেল্ফি চাই আমাদের। নিজেকে জাহির
করার ঢেউয়ে ভাসতে ও ভাসাতে সভ্যতার ভাসানযাত্রায় অসভ্যতার সিটির আগে পিকনিক শব্দটিতেই
ধরার চেষ্টা হয়েছে এসময়ের কথা ।
এভাবেই একটু একটু করে কবিতার শরীর নির্মিত হয়েছে। কবিতাটির আধার সময়। ব্যক্তি
মানুষের চিন্তাভাবনায় আছে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির কথাও। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলির
বহুমাত্রিক অর্থে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি এবং চেষ্টা করেছি
কবিতাটিও
বহুমাত্রিক করার। আসলে, আমার প্রতিটি কবিতাই একটা চেষ্টা। জানিনা সেই চেষ্টায় কি গড়তে
কি গড়ে ফেলি!
বিগত চল্লিশ বছর ধরে নানারকম লেখা লিখলেও এখনো প্রতিটি লেখার পরেই
আমার ব্যক্তিমননে এক আশ্চর্য সংশয় উপলব্ধি করি। আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে কুয়াশার
মতো জড়িয়ে থাকে সেই সংশয়, কিছু কি হয়েছে! হোলো কি কিছু আদৌ! আমি কি বাংলা সাহিত্যে
জঞ্জালই বৃদ্ধি করছি! এই ভাবনা,এই
সংশয় আমাকে কুরে কুরে খায় সবসময়। না, নিজের কবিতাকে এভাবে ভেঙে খানখান করিনি কোনোদিন।
কবিতার হৃদয় খুঁড়ে পাঠক
যখন তার মর্মোদ্ধার করেন তখন একজন কবি কি জানতে
পারেন পাঠকের অনুভব! আমার অনন্ত প্রতীক্ষা
সেই সব পাঠকদের জন্য। তাঁরা আমার কাছে ঈশ্বর। তাঁদের সমালোচনা আমার কাছে আশীর্বাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন