অভিজিৎ মান এর কবিতা

 

                           

অভিজিৎ মান এর কবিতা




ডিফিউশন


নদী বয়ে যাওয়ার মতো

শুকনো মাঠে রোদ পড়ার মতো

বায়োপসি হওয়া শরীরের মতো।

মুক্তি দিয়েছো।

সোরিয়াসিস বাড়ি বানিয়েছে।

ভোর ৩.৪৬ অব্দি নিম গাছের চেহারা দেখলাম।

সিগারেটের অপেক্ষা রাখে।

অপেক্ষা ছিল সাদা পেঁচাটার।

 

সালিম আলী বুঝেছিল আর আমি বুঝলাম

রোগ, পাখিটার রোগ

বাসা পাল্টানো ধর্মে

বাসা পাল্টানো এদের জিনে।

শান্ত চোখ গুলো মনে পড়ে

ভিডিও কলে ঘর পাল্টায়

স্বপ্নেরও মুক্তি জীবনানন্দের কবিতায়।

মুক্তি দিয়েছো।

মা শীতলার অপেক্ষায় থাকি।

              

 

ভাইরাস           

                            

অনেক ভালো ছিলাম।

উত্তরে শীতের কনকনে বাতাস ছিল না।

ছিল না ভোর রাতের ফোন

নিশ্চুপ নির্বাক ইউটিউব।


ছিল না গোল গোল কুন্ডুলিত

রাতভোর।

বুকের ভিতরের গুমসে যাওয়া আওয়াজ ।

বারমুডা ট্রাঙ্গেলের ভেতরে চলে যায় স্ট্যাটাস মেসেঞ্জার।


বড় খাপ, খাপের ভেতর আমি

তোমার চোখ স্থির

খাপ বানাতে তুমি পটু।

রঙিন খাপ বানিয়েছ। ভিতরে ভিতরে  আলো ছড়িয়েছে। মদন মোহন সাক্ষী থাকলেন।


তাহলে কি আমি আবার জবাই হলাম?

 

 

পোস্টমর্টেম

 

তুমি বুঝতেই পারবে না

কখন তোমার উপর দিয়ে মনোলিনগূয়েল হাইপোথিসিসের বাতাস বইবে।

সে সময় বাতাস হয়তো তোমার ভালো লাগবে না।

অভ্যাস হবে। তারপর।

মনে হবে পৃথিবীটা তোমার

মনে হবে চারিদিকে আনন্দ।

ছবি কথা সব আইফেল টাওয়ার মনে হবে।

ইচ্ছে অনিচ্ছাতে

শরীর তুচ্ছ

মন তুচ্ছ

উষ্ণতার আতর

আর শুধু সময়ের বড় বড় প্যাকেজ নিয়ে

হৃদয়ে হৃদয়ে আঠা লেগে যাবে।


তারপর একদিন কোন এক গ্রামে মদনমোহন সাক্ষী হয়ে থাকবেন।

ইমোশনাল টর্চার চলবে।

পোস্টমর্টেমের খবর হবে।

 

 

ডিমোশন

          

একটার পর একটা পাথর সাজিয়ে

তৈরি হল কাঁচা মন্দির

ভরসার, আবেগের

সব,ই মালিকের ইচ্ছে।

 

মালিক এবং শিল্পী দুজনের ভাবনায়

শুরু হলো কারুকার্য চলতে থাকল এক মাস দুমাস

টেরাকোটা, ভেতরে ডোকরা, বীর হাম্বী ভাবনায়।

মালিক শিল্পী একদিন প্রাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে

কাছাকাছি এসেছে।

প্রাণ ও‌ প্রতিষ্ঠা হল।

সময় করে উপাসনা

রীতিমত যাগ যজ্ঞ বিজ্ঞান


হঠাৎ মালিকের ইছে হল বিগ্রহ আর রাখবে না। ছাড়তে চাইনা শিল্পী।

এরপর কি মন্দিরটা ধ্বংস হয়ে যাবে?

এরপর কি শিল্পী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে?

গন্ডা খানেক সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট।

শিল্পীর ডিমোশন হয়েছে নাকি!


তবুও ঈশ্বর থেকে গেল।

ঈশ্বরকে টলানো গেল না।

হয়তো মালিক ফিরে আসবে।

হয়তো শিল্পীর ডিমোশন হবে না।

 

মহলম          


তোমরা মহলম মাখাতে যাচ্ছ।

মাখিয়ে নিচ্ছ মহলম।

নামিদামি ব্র্যান্ড।


কত সহজে রাস্তা পারাপার করছো

মন পারাপার করছো।

চিরকুটে তোমাদের নাম বন্দী হয়ে থাকছে।

এই চিরকুট চিত্রগুপ্তের নয়।


সুবোধ বাউরির ছেলে ব্যাটারির।

হাফ দিন মজুর এখন।

সন্ধ্যায় তাসা বাজায় মদ তাকে ধরেনি।

অসুখ হয়েছে।

 

মন্টু পারসির ছেলে ঝিকিমিকি।

মারওয়ারী দোকানে কাজ করে।

অসুখ হয়েছে ।


আর আমরা

বউয়ের পাশে বসে মিউচুয়াল ফান্ডের হিসাব করি।

মহলম মাখিয়ে ।

মহলম মাখিয়ে ।

পত্রপত্রিকা পড়ি। সাহিত্য করি।


আমাদের কোনদিন কোন অসুখ হয় না।

অসুখ হবেও না

নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখি।

বিসনয় আমাদের চারপাশে রয়েছে।

আমার পৃথিবী আমার কবিতা




বিতার  হৃদয় খুঁড়ে পাঠক যখন তার মর্মোদ্ধার করেন তখন একজন  কবি কি জানতে পারেন পাঠকের অনুভব! আমার অনন্ত  প্রতীক্ষা সেই সব পাঠকদের জন্য। তাঁরা আমার কাছে ঈশ্বর। তাঁদের সমালোচনা আমার কাছে আশীর্বাদ।





পদ্য থেকে গদ্যে

 ভজন দত্ত

“আকাশের অজস্র নীলখিদের পেটে গরম গরম ল্যাংচা এঁকে ঝুলিয়ে দিচ্ছো, তোমার কারা!

সমাধিস্থলে এঁটোকাঁটার উল্লাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টুম্পা নাচে পিকনিক সিটি মেরে সেল্ফি খিঁচে গেছে যারা, তারাই বা কারা!

ছেঁড়াদড়ির খাটিয়ায় শুয়ে থাকা মানুষগুলোকে শুশনি শাক ও কলমিলতা অনলাইনে কেনার জন্য জোরাজুরি করছে যারা, তারাই বা কারা!

কুরচি ফুল,শাল ফুল,পিয়াল ফল, সীতাপাতা লুঠ নিয়ে যারা সেমিনারে পাত পেড়ে খেয়ে গেল, ওরা কি মানুষ! ওরা কি ভুখা!

মরানদী, ধুধু বালি, ফুটিফাটা মাটি দেখে যারা কুমিরের কান্না গেয়ে গেল মশকরা রসে,তারা, তারা কারা!

কারা যেন বলেছিল 'টোনাটুনির সংসারে ছিটকানি! জরুরত কেয়া!' রামনাম সত্য করে ওদের জলজমিজঙ্গল লুঠ করে 'পাল্লামেন্টে' পাল্লা ভারি করার কামড়াকামড়ি খেলা খেলে যারা, তারা কারা!

২৪×৭ ফিরির নেট খাইয়ে বিশুদ্ধ অক্সিজেন হাহাকারের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে যারা ঘুষের টাকার দালালি খেল,তারাই বা কারা!

মানুষ জন্মকথাকে যারা চির নষ্টকথায় বদলে মানুষে মানুষে ভিনু করে দিল সেই ব্যাপারীদের বাড়তে দিল কারা!

 এমত সকল বিস্ময় বিস্তারিত হলে কবিতা আর কবিতা থাকে না আনারকলি!

চলো, এবার পদ্য থেকে গদ্যের দিকে ছুটে  চলো। মগজে শীত জমছে! বিছানার এত রোদ খিদে বাড়ছে রোজ!

চলো, রোদ ধরাধরি করি শীতলতম দিনে, না হলে খেজুর গাছে চড়ে দেখো,পৃথিবীতে রোদ ও নলেনগুড়ের কদর আজও তেমনি রয়েছে…”

 

নিজের কবিতা নিয়ে লেখা শোভনীয়, না কি কালবৈশাখী, সেই কথাটি জানেন মশাই সম্পাদক । এই যে কবিতাটি আপনাদের সমীপে রাখলাম এর জন্ম ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ, তিথি নক্ষত্র পাঠকের পাঠ সময়,  এর জন্মস্থান জঙ্গলমহল। জঙ্গলমহলের বিস্তৃতি ধরতে গেলে পাঠককে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার প্রকৃতি,  সাধারণ গরীব খেটেখাওয়া মানুষের যাপন, জীবনের কাছে এসে দাঁড়াতে হবে। সর্বোপরি, মনে রাখতে হবে সময়, যে সময় আমরা পার হয়ে চলেছি সেই সময়।সময়ের মার সহ্য করতেই হয়।  এই সময়ে ভার্চুয়াল আনন্দ, শোক, রাগ, ঘৃণা,বিপ্লব নিয়ে আমরা যখন মাতামাতি করছি। সেই সময়কে ভুলে, মানুষকে ভুলে আমরা যখন উল্লাসে চরম ডুবতে ডুবতে দমবন্ধ হয়ে হাঁকপাঁক করছি, এই কবিতাটি  সেই সময়ের কবিতা।

জঙ্গল মহল থেকে হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই, তবুও  এখনো যা আছে তা হলো গর্ব করার মতো উদার অকৃপন প্রকৃতি। প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে  বিস্ময়সূচক চিহ্নটি আগে ভেবে নিন, তারপর পড়ুন,

আকাশের অজস্র নীলখিদের পেটে গরম গরম ল্যাংচা এঁকে ঝুলিয়ে দিচ্ছো, তোমার কারা  

 আকাশে যতই নীল ভরে ঠেসে দিন না কেন, তার পেট ভরানো স্বয়ং স্রষ্টার পক্ষেও কি সম্ভব! বিস্ময় সূচক চিহ্নটিকে ল্যাংচা ধরলে এই পঙক্তিকে ধরা যায়। ল্যাংচা জঙ্গলমহলের এক জনপ্রিয় মিষ্টি। যা সাধারণত ‘বাবুঘরের’ ‘বিহাঘর’ কিংবা কোনো ভোজঘরের শেষ পাতে নিমন্ত্রিতদের পরিবেশন করা হয়। কিন্তু এখানে ‘নীলখিদে’ এই সমাসবদ্ধ শব্দটি দিয়ে আরেক খিদের কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। পৃথিবীতে পেটের নিচের খিদেও কি কিছু কম!

দ্বিতীয় প্যারাটি আরেকবার পড়ুন

“সমাধিস্থলে এঁটোকাঁটার উল্লাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টুম্পা নাচে পিকনিক সিটি মেরে সেল্ফি খিঁচে গেছে যারা, তারাই বা কারা! ”

যে জঙ্গলে আমাদের বাপদাদাদেরর স্মৃতি রয়ে গেছে সেখানে দেখবেন পিকনিকের সময় নাগরিকদের উল্লাস। এখানে সেখানে মদের ভাঙা বোতলে নগ্নপদ হেঁটে গেলে পা রক্তাক্ত হবেই । সেলফিস সেল্ফির এই পৃথিবীতে হরদম সেল্ফি চাই আমাদের। নিজেকে জাহির করার ঢেউয়ে ভাসতে ও ভাসাতে সভ্যতার ভাসানযাত্রায় অসভ্যতার সিটির আগে পিকনিক শব্দটিতেই ধরার চেষ্টা হয়েছে এসময়ের কথা ।

এভাবেই একটু একটু করে কবিতার শরীর  নির্মিত হয়েছে। কবিতাটির  আধার সময়। ব্যক্তি মানুষের চিন্তাভাবনায় আছে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির কথাও। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলির বহুমাত্রিক অর্থে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি এবং চেষ্টা করেছি

 কবিতাটিও বহুমাত্রিক করার। আসলে, আমার প্রতিটি কবিতাই একটা চেষ্টা। জানিনা সেই চেষ্টায় কি গড়তে কি গড়ে ফেলি!

বিগত চল্লিশ বছর ধরে নানারকম লেখা লিখলেও এখনো  প্রতিটি লেখার পরেই আমার ব্যক্তিমননে এক আশ্চর্য সংশয় উপলব্ধি করি। আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে কুয়াশার মতো জড়িয়ে থাকে সেই সংশয়, কিছু কি হয়েছে! হোলো কি কিছু আদৌ! আমি কি বাংলা সাহিত্যে জঞ্জালই বৃদ্ধি করছি!  এই ভাবনা,এই সংশয় আমাকে কুরে কুরে খায় সবসময়। না, নিজের কবিতাকে এভাবে ভেঙে খানখান করিনি কোনোদিন। কবিতার  হৃদয় খুঁড়ে পাঠক যখন তার মর্মোদ্ধার করেন তখন একজন  কবি কি জানতে পারেন পাঠকের অনুভব! আমার অনন্ত  প্রতীক্ষা সেই সব পাঠকদের জন্য। তাঁরা আমার কাছে ঈশ্বর। তাঁদের সমালোচনা আমার কাছে আশীর্বাদ।

 


আমার পৃথিবী আমার কবিতা



 দী নে শ  ক র      

একটি কবিতার  প্রেক্ষাপট এবং পদধ্বনি

 

 

স্মরণীয় ঘোর
 
খন ঠিক করলাম, বলা চলে অটুট সিদ্ধান্ত নিলাম,
প্রধানত কবিতা নিয়েই এই জীবন কাটাব, তারও আঠারো বছর পর
প্রকাশিত হ'ল আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
পৃথিবী ঘিরে কাজেই প্রথম সন্তান। দুই মলাটের ভেতর মুদ্রিত অক্ষরমালা।
তার ওঠানামা। আলো-অন্ধকার। আদর-আপ্যায়ন।
প্রথম পিতাজন্মের অনন্য অভিজ্ঞতায় কম্পমান ধরিত্রী।
আনন্দ-আচ্ছন্নতা। অনেকটা উন্মাদনাও। সংযমিত আবেগ
কোথাও কোথাও অসংযমী।
সর্বোপরি এতো এতো মানুষ এতো প্রবল উৎসাহে বইটি সংগ্রহ করলেন,
সামাজিক মাধ্যমে পত্র-পত্রিকায় মৌখিকভাবে সুবাতাসের মতো
পাঠপ্রতিক্রিয়া জানালেন যে,
স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধায় আমার মাথানীচু।
সব মিলিয়ে স্মরণীয় ঘোর। নিমজ্জিত চরাচর।
অনন্যোপায় সে-ইশারায় সাড়া দিতে আগ্রহী সমগ্র।
বই বেরোলো ঠিকই, বইটি থেকে আমি বেরোতে পারলাম না বহুদিন।
বিস্ময়ের হ’লেও (অথবা বিস্ময়ের কিছু নেই) সত্য এই,
আমার লেখালেখিতে অন্তরায় হ'য়ে দাঁড়াল
আমারই অন্তর-নির্গত আশ্চর্য বসুন্ধরা।
প্রাচীরের ভঙ্গিমায়। বারবার সেই কাব্যভাষা, শব্দচয়নের এক সীমাবদ্ধতা,
আরম্ভ-অন্তিমে একইরকম সূচনা-সমাপ্তি।
বৃত্ত-বৃত্ত। পরিধি জুড়ে ঘূর্ণন। নিস্তার নেই। চরম অস্থিরতায় আক্রান্ত ভুবন।
দীর্ঘকাল সুতরাং চুপচাপ। কাগজ-কলমের ছুটি।
কেবল পড়াশোনা। ঘোরাঘুরি। মাঝে মাঝে ধ্যানমগ্ন।
বিস্মরণের তপস্যা। সুনিবিড়। নিজেকে অনুসরণের পরিবর্তে
নিজেকেই অতিক্রমের অদম্য আকাঙ্ক্ষায়।
 
 
আরাধ্য সূর্যোদয়
 
তিমধ্যে কয়েকজন এমনি এসেছিল এমনি চলে গেল।
এসেছিল। কারণ, চারিত্রিক ঋজুতা। আদর্শের আকর্ষণ। অন্তত সাহিত্যচর্চায়।
ধর্মপ্রাণদের ধর্ম যেমন। নির্ধারিত দূরত্বেই তা শুধু অসাধারণ।
আরাধ্য সূর্যোদয়।
চলে গেল। যেহেতু তার সঙ্গে, আর যাইহোক, হাতে হাত হাঁটা যায় না।
প্রতিটি ঋতুকে রাঙানো যায় না হৃদয়-উত্থিত অনুরাগে।
ঘনিষ্ঠতা এক্ষেত্রে যন্ত্রণার সমনাম।
আকাশ ভেঙে পড়ল না তবু। বাতাস স্তব্ধ হ'ল না। উপর-উপর
এমনই মনে হবে। ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন নেই বিন্দুমাত্র।
অন্দরমহল আসলে তোলপাড়। উথাল-পাথাল ঢেউ সেখানে। সম্পর্ককে যে কবেই
স্থাপন করেছিল সে সুমহান উচ্চতায়। মানসিক মেলবন্ধনকে রেখেছিল
মন্ত্রের বিভায়। অন্য-অন্য অর্জনে চুরমার অবশেষে
এ-অর্জনের প্রতিমা।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে ছিল বন্ধুরও অতিরিক্ত।
অনিবার্যতায় আবার সেই অতীত। দশ অস্ত্রে আটকালো দশদিক। সংখ্য-অসংখ্য
রোদরাত্রিকে প্রেমিকা মেনে। কোনোখানে যাওয়ার নেই বুঝি।
ফেরারও নেই কোনোখানে।
এই আসা-যাওয়ার মাঝখানে অতএব একা-একা
আমার গোধূলি। পাখিদেরও বাসা আছে। প্রজাপতিরও আস্তানা।
জীবনানন্দের উচ্চারণ তখন আমারও উচ্চারণ,
‘কেউ নেই, কিছু নেই --- সূর্য নিভে গেছে’।
সমস্ত সুস্থির হ’তে হ’তে অঞ্জলি হ'তে খসে পড়লো অনেক সময়।
পরমায়ুর খণ্ডাংশ। অমানিশা শেষমেশ
পূর্ণিমায় রূপান্তরিত। এর তুলনা নেই। যথার্থ সমার্থক। পায়রা শান্তি হ'য়ে উড়ছে ওই।
যেন সবে শ্মশান হ'তে ফিরেছি। কারও জন্য কোনো
শোক সাজানো নেই। যে জুটবে তারই চারপাশে মেধা-মায়া-মোহ।
 
 
সাক্ষী নৈঃশব্দ্য 
 
পুনর্জন্ম পুনরায়। জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ এইসব সংশয়-জিজ্ঞাসার পাহাড়
পেরোতে পেরোতে। শুক্রাণু-ডিম্বাণুর খেলা। সঙ্গম-অন্তিমে অভিনব উদ্ধার।
শিরোনামে লালন ফকির:
থাক না মন একান্ত হয়ে
 
চ.

টুকরো টুকরো পরিচয়ে যে-পৃথিবী, সেখানে সব চরিত্র তুলতে তুলতে
আরও আরও পৃথিবী। কারও মুখে আজন্মের তিল, কেউ ভুল বানানে
লিখেছে বিকেল। কাকে নেবে তবে, সংলাপ রাখবে কার ওষ্ঠে --- ভাবতে ভাবতে
চিরকাল অরক্ষিত দুয়ার। প্রবেশ শুধু সত্য। প্রস্থানের পিছু পিছু
কতো কতো ডালপালা। নিভন্ত প্রহর।
 
সেই থেকে নেওয়া নেই। যাচাইয়ের অন্ধকারে
যতটুকু আলো...
 

ছ.

ন্তরিকতা একটি শব্দ নয়, আমাদের আশ্রয় --- তোমাকে বলেছিলাম।
দ্বিধায় শুধু নিজেকে দুলিও না। সে না-এলে অন্য, অন্য না-হলে অপর।
এবং বিন্যাস। ঠিক অবস্থানে সঠিক উপস্থিতি। জমানো ভোর। তোমার
আমার নিবেদন। বোঝাতে বোঝাতে সন্ধ্যা ফুরিয়ে এলো। এখন রাত্রি।
মুখোমুখি হও, সাক্ষী নৈঃশব্দ্য।
 
বলো, কী কী বলার ছিল। কী কী উপকরণকে পাঠক বলবে,
এ তো আমারই, প্রিয় গতজন্ম...

 


আমার পৃথিবী আমার কবিতা

ফাঁদ
আশরাফুল মণ্ডল

কিছুকাল আগেও ছাদে ঘুঘু নামতো
কিশোর আমরা ফাঁদ পেতে রাখতাম
ঘুঘু নির্বিঘ্নে রোদে সেঁকা শস্য খুঁটতো
খিদের আগুন নিভলেই ফুড়ুৎ
অসহায় ফাঁদ তাকিয়ে থাকতো 
ফ্যালফ্যাল

এখন ছাদ ভর্তি রোদ
ফাঁকা মরুভূমি
শস্য নেই কোনো
আমাদের চারপাশে ফাঁদের টিলা
ঘুঘু হয়ে দানাপানি খুঁজি
এদিকওদিক হলেই ফাঁদবন্দি

ফাঁদহীন ছাদ কোথায়
কে জানে



এই কবিতার জন্ম এক অলস দুপুরে। ছাদের নির্জনতায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঘুঘুর অভাব অনুভবে। মনে পড়ে গেল শৈশবের সেই সরল ফাঁদ। রোদে-রাঙা ছাদ আর ক্ষুধার সাদা পাখিরা। এক ঝলক হাওয়ার সঙ্গে মনে এলো পুরোনো দিনের ফাঁদ। ঘুঘু। ছেলেবেলা। যেন সেই ফাঁদ ছিল খেলার মতো! এখনকারগুলো জীবন-খেকো। শস্য ছিল। ছিল ছুটে যাওয়া পাখি। 

এখন শুধু ফাঁদের মতো চারপাশ। নিরুপায়। নীরব। আমি নিজেই যেন ঘুঘু হয়ে গেছি! ফাঁদের দিকে পা বাড়াই! 

এই কবিতা আসলে এক আর্তনাদ। পাখিদের নয়। মানুষের। ছাদ হারিয়েছে তার সরলতা। ফাঁদ পেয়েছে এখন গোপন জিভ। ঘুঘুর বদলে  উড়ে যেতে চাই, আমরা এখন। কিন্তু কোথাও আর ফাঁদহীন আকাশ নেই।

আমি যখন ‘ফাঁদ’ কবিতাটি লিখি, তখন আমার মনের মধ্যে একটা সময়চক্র ঘুরছিল। একটা সময় ছিল। সেই সময়টা শৈশব-কৈশোর। যখন মনে কোনোও জটিলতা ছিল না। সরলতা ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে এক নিবিড় সহবাস ছিল। ছাদে ঘুঘু নামতো। আমরা ফাঁদ পেতে রাখতাম। সেটা ছিল একধরনের খেলা। একধরনের জীবনচর্চা। যেখানে ধরা-পড়ার ব্যঞ্জনা ছিল, কিন্তু নির্মমতা ছিল না।

এই কবিতার প্রথম স্তবকে আমি সেই অতীতকে ফিরিয়ে এনেছি। শব্দচয়ন করেছি খুব সচেতনভাবে। যেমন—“ঘুঘু”, “ফাঁদ”, “রোদ”, “শস্য”, “ফুড়ুৎ”, “ফ্যালফ্যাল”—এই শব্দগুলো বেছে নিয়েছি কারণ এদের মধ্যে একটা গ্রামীণ নস্টালজিয়া আছে। একটা শ্রুতিমধুরতা আছে। আর দৃশ্য নির্মাণেও সহায়ক হয়েছে।

"কিছুকাল আগেও ছাদে ঘুঘু নামতো"—এই লাইনটি দিয়ে আমি সময়কে টেনে আনি—“কিছুকাল আগেও” মানে অতীত খুব সুদূর নয়, অথচ তার সঙ্গে বর্তমানের এক ছেদ ঘটেছে।

“কিশোর আমরা ফাঁদ পেতে রাখতাম”—এই লাইনটা ‘আমরা’র মাধ্যমে গোষ্ঠীসত্তা নির্মাণ করতে চেয়েছি। যেন শুধু আমি নই, অনেকেই ছিল! এখানে সময়টা কৈশোর। জীবনের এক নিষ্কলুষ সময়।

আমি চাইনি অতীতকে রোমান্টিসাইজ করতে। কিন্তু একটা নরম আলো ফেলতে চেয়েছি। “ঘুঘু নির্বিঘ্নে রোদে সেঁকা শস্য খুঁটতো”—এই লাইনটি আমি গড়েছি যেন পাঠকের চোখে একটা দৃশ্য ফুটে ওঠে! শস্য খোঁজা, রোদে বসা প্রকৃতপক্ষে ঘুঘুর নিরাপত্তাবোধের অনুসঙ্গ। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ।

তবে ঠিক পরের ছত্রেই—“খিদের আগুন নিভলেই ফুড়ুৎ”—এই ‘ফুড়ুৎ’ শব্দটা আমি রেখেছি অনুকারধ্বনির জন্য। যেন শব্দের মধ্যেই একটা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আছে! খিদের আগুন নিভে গেলে সে উড়ে যায়। অথচ আমরা চাইতাম সে ধরা পড়ুক।

আর এরপরই যে চিত্রটি আমি দিতে চেয়েছি, তা হলো—“অসহায় ফাঁদ তাকিয়ে থাকতো / ফ্যালফ্যাল”। এই ‘ফাঁদ’ এখানে কেবল একটি বস্তু নয়। এ এক জীবন্ত অনুভূতি। সে তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে। ‘ফ্যালফ্যাল’ শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি ভাষার খেলায়। একটি চোখের ভাষা তৈরি করতে। যেন সে হেরে গেছে! যেন বঞ্চিত হয়েছে! এই স্তবকে শব্দের গঠন আর বাক্যের বিন্যাস সরল রেখেছি। যাতে কবিতাটি পড়বার সময় প্রিয় পাঠকের কোনো প্রতিবন্ধকতা না আসে। তবে সরলতা যেন শূন্যতা না হয়ে পড়ে, তাই ধ্বনিগত বিন্যাসে ছন্দ ও প্রতিধ্বনি রেখেছি।

“এখন ছাদ ভর্তি রোদ / ফাঁকা মরুভূমি”—এই দুটি পঙ্‌ক্তি দিয়েই আমি বর্তমানের অসাড়তাকে ধরতে চেয়েছি। রোদ আছে। ছাদ আছে। কিন্তু ঘুঘু নেই। শস্য নেই। ‘রোদ’ এখানে নিছক আলো নয়। এ হল একধরনের ক্লান্তি। একধরনের তাপ। যেখানে জীবনের প্রশান্তি নেই। আছে জ্বালা। আর ছাদ হয়ে উঠেছে এক ‘ফাঁকা মরুভূমি’। এই চিত্রকল্পটি আমি বেছে নিয়েছি নিঃসঙ্গতা, বন্ধ্যাত্ব এবং নৈঃসঙ্গের রূপ দিতে।

এরপরই আসে আমার কবিতার মোচড়—যেখানে আমি আমার পাঠককে হঠাৎ করে ঘুঘুর দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের দৃষ্টিকোণে সরিয়ে নিয়ে আসি। “আমাদের চারপাশে ফাঁদের টিলা”— এই ‘টিলা’ শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি প্রতীক হিসেবে। যেন ফাঁদ আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই! বরং তারা স্তূপ হয়ে গেছে! আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিপদ। কৌশল। শোষণ। দমন। প্রতারণা। এখানে সমাজের রূপক এসে পড়ে।

“ঘুঘু হয়ে দানাপানি খুঁজি / এদিকওদিক হলেই ফাঁদবন্দি”—এই দুই ছত্রে আমি নিজেকে এবং আমার সমকালীন মানুষদের ঘুঘু হিসেবে চিত্রিত করেছি। এখন আমরা সেই নিরীহ, ক্ষুধার্ত প্রাণী, যারা একটু শস্য খুঁজি। একটু শান্তি খুঁজি। একটু ভালোবাসা খুঁজি। কিন্তু আমাদের চারদিকে ফাঁদ যেন পেতে রাখা হয়েছে। যাতে আমরা বিপন্ন হই। আমাদের সমূহ প্রতিবেশে সর্বনাশা জাল ছড়ানো আছে। এক পা এদিকেই বা ওদিকেই হলেই ‘ফাঁদবন্দি’ হয়ে যাওয়ার ঘোরতর সম্ভাবনা। এই অংশটি মূলত আমাদের সমাজ-বাস্তবতার এক কঠোর চিত্র। আজ আমরা চাকরি খুঁজি, মর্যাদা খুঁজি, একটু শ্বাস নেওয়ার জায়গা খুঁজি— কিন্তু সর্বত্র ফাঁদ।

“ফাঁদহীন ছাদ কোথায় / কে জানে”—এই দুটি পঙ্‌ক্তি দিয়েই আমি কবিতার সমাপ্তি টানি, কিন্তু প্রশ্ন রেখে দিই। কোনো নিশ্চিত উত্তর নেই এখানে। আমি নিজেও জানি না কোথাও কি সত্যিই ‘ফাঁদহীন ছাদ’ আছে? যেখানে কেউ আমাদের দমিয়ে দেবে না? বাঁধবে না? কোনো শর্ত দেবে না? এ একধরনের নিঃসঙ্গ প্রশ্ন, যা পাঠকের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। এই জায়গায় এসে কবিতা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সমষ্টিগত চেতনার দিকে পৌঁছে যাক - এই আমার একান্ত প্রত্যাশা। আর আমি মনে করি এই প্রশ্নটিই কবিতার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রস্তাব।

এই কবিতার প্রধান রূপক হল—“ফাঁদ”। প্রথমে এই রূপকটি বাস্তব বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। প্রথমে এখানে ফাঁদ বলতে পাখি ধরার যন্ত্র বোঝাতে চেয়েছি। পরবর্তীতে এটি রূপান্তরিত হয়েছে সমাজের জালে। শোষণের কৌশলে। জীবনের এক অনিবার্য শৃঙ্খলে।

ঘুঘুও একটি রূপক। প্রথম স্তবকে সে শিকার। দ্বিতীয় স্তবকে সে আসলে  তো এই আমরা সেই সমষ্টি - যারা নিরুপায়, ক্ষুধার্ত, আশ্রয়প্রার্থী।

এই কবিতায় আমি চিত্রকল্প নির্মাণ করেছি সংক্ষিপ্ত অথচ দৃশ্যমান শব্দ দিয়ে। যেমন ছাদে ঘুঘু নামা, ফাঁদ পেতে রাখা, শস্য খোঁজা, ফাঁকা মরুভূমির টিলা হয়ে থাকা ফাঁদ, ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকা। প্রত্যেকটি চিত্র যেন একেকটি দৃশ্যরূপ! যেন পাঠকের চোখে তা ভেসে ওঠে! আমি চেয়েছি শব্দ যেন ছন্দ ও ভাব দুটোই বহন করে। সেজন্য কোনো অলঙ্কার-বৈভবে কবিতাটিকে ভারাক্রান্ত করিনি। বরং জৈব ভাষা, সহজ বাক্যচিত্র, হালকা ধ্বনির প্রতিধ্বনি নির্মাণের চেষ্টা করেছি। ছোট ছোট বাক্যে আমি একটা ক্লান্তির অনুসঙ্গ এনেছি। যেমন : “ফাঁকা মরুভূমি," “ফাঁদহীন ছাদ কোথায়” ইত্যাদি। এসব বাক্য ছোট কিন্তু উচ্চারণে একটি দার্শনিক ভাব আছে। আমি চেয়েছি কবিতা যেন অর্থ ও অনুভব এই দু’পাশেই সমানভাবে ভর করে দাঁড়ায়।

কবিতা হিসাবে "ফাঁদ" কতটা সার্থক - এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। কারণ একবার লেখা হয়ে গেলে কবিতা পাঠকের সম্পত্তি হয়ে যায় বলেই জানি। তবু আমি বলতে পারি ‘ফাঁদ’ লেখার সময় আমি নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়েছিলাম। আমার কৈশোরের স্মৃতি, বর্তমানের বিষণ্ণতা, সমাজের জটিলতা, এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—এই সবকিছু একত্রে এনে কয়েকটি পঙ্‌ক্তিতে ধরতে চেয়েছি।

আমি চেয়েছি আমার পাঠক যেন এই কবিতাটি পড়ে নিজের জীবনের ছাদে ফিরে যান—যেখানে তিনি কোনোদিন ঘুঘু দেখেছিলেন, কিংবা আজ নিজেকেই ঘুঘু মনে করেন।

‘ফাঁদ’ আমার কাছে এক জীবনদর্শন। এক সামাজিক উপমা। এক নৈঃসঙ্গের আত্মকথন।

আশরাফুল মণ্ডলের কবিতা

আশরাফুল মণ্ডলের কবিতা


ছুঁয়ে যাও নাবিকের হাত

এক সাগর নিকষ অন্ধকার বালুকাবেলায়
হালভাঙা নাবিক আছি নিঃশব্দ পাহারায়
তুমি এলে জাফরান আঁচলের ঘ্রাণ
সর্বরিক্ত নাবিক তবে বুক চিতিয়ে মোহানায়

তোমার কাছেই যাব চলে জন্মান্তর
ভালো লাগে না আর রণবাদ্য
অর্থ যশের বিবমিষা দেমাক
ধরো হাত জবালা যাই চলো কুশক্ষেত্রে
শিখে নেবো ইতিহাস সত্য জন্মের
যন্ত্রণার শরে উপহাস বিঁধে হব সত্যকাম পিতা
বাসনার বিভঙ্গ সকল তুমি নাও রত্নগর্ভা
অনুচ্চারিত অক্ষরমালা তোমাকে দিলাম
খুঁজে ফিরি কৈশোরের স্বপ্ন বোঝাই জাহাজ

যেতে চাই যাবোই তোমার কাছে
জাফরান আঁচলের পাকে জড়িয়ে নাও
ছেয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে মাস্তুলের সোহাগ
সত্যের খোঁজে উন্মাদ তোমার দারুচিনি চোখ
দিশারী হবেই যত হালভাঙ্গা নাবিকের.....


মাস্টারি

                   
ছেলেরা মেয়েদের দিকে নজর রাখো
মেয়েরা ছেলেদের দিকে নজর রাখো
তোমরা কেউই সন্দেহের উর্ধ্বে নও

ছেলেরা যখন মেয়েদের কথা শুনবে
মেয়েরা যখন ছেলেদের কথা শুনবে
গভীর বোঝাপড়ায় ঠিক হোক তোমরা কি চাও

তোমাদের পারস্পরিক মতবিনিময় জরুরী
বুঝবে যখন সব ঠিকঠাক
আমাকে খবর দিও সত্ত্বর
অঙ্কের স্যারকে পাঠিয়ে দেব তৎক্ষণাৎ
শেখাবেন তিনি তোমাদের
দুই এক্কে দুই
দুই দু গুণে চার...


মনে পড়ে

কতবার বলেছি তাকে মনে পড়ে
খুব মনে পড়ে
কালো মেঘ ঘনিয়ে এলে
বৃষ্টি পড়লে
ঘন ঘন বাজ পড়লে
কিম্বা ধরো তুমুল ঝগড়া হলে

বারবার বলেছি মনে পড়ে মনে পড়ে

এখন হয়তো সে বেশ ভালো আছে
গাড়ি বাড়ি চাকর বাকর
আত্মীয় স্বজন
নদী নদী সুখ

তবুও আমার মনে পড়ে
নিকানো উঠোন ছেঁচ্ তলা
ছিঁচকে কাঁদন মুচকি হাসি
ফালতু তর্ক ঝগড়াঝাটি
আবার কাছাকাছি


আজও মনে পড়ে খুব মনে পড়ে...

রুদ্র পতি - বাংলা কবিতায় প্রান্তিক চাষার স্বর

রুদ্র পতি - বাংলা কবিতায় প্রান্তিক চাষার স্বর 

                                                     

ড. সুপ্রিয় দেওঘরিয়া



রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতায় বেশ কিছু বাঁক বদল এসেছে। অনেক কবি উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছেন তাঁদের নির্দিষ্ট শৈলীতে এবং বিশেষতায়। সাম্প্রতিক কবিতা চর্চার যে দুটো দশক আমার বিশেষভাবে ভালো লাগে তা অবশ্যই  সত্তর এবং নব্বইয়ের দশক। এই দুই দশকেই নিজস্বতায় পরিপূর্ণ বেশ কিছু দক্ষ কবির সাথে পরিচিত হতে পারি। বিশেষকরে নব্বইয়ের দশকের কবিদের মধ্যে কারো লেখায় ফুটে উঠেছে দেশভাগের যন্ত্রণা, উদবাস্তু সমস্যা। কারো লেখায় ফুটে উঠেছে নাগরিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। কেউ ছন্দে একাকার হয়েছেন।  আবার কেউ বুক চিতিয়ে শহরের সাথে পাল্লা দিয়ে মফস্বলের লড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। প্রত্যেককে নিজের ক্ষেত্রে সম্মান জানিয়ে, একটা কথা এখানে বলতেই পারা যায় যে নব্বইয়ের দশকের আর কোনো কবি শুধুমাত্র 'অমরত্ব' পাবার আশায়, আলেয়ার মতো এক অমোঘ মোহতে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে, কবিতার কলমকে করে তুলেছিলেন লাঙ্গলের ফলা, নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন এক প্রান্তিক চাষী হিসেবে, লিখেছিলেন --
"মাটি ফাটার দিন ; বুকও ফেটেছে...
#
 ফাটুক;
এই ফাটা -পথ দিয়েই 
 আষাঢ়ের জল ঢুকবে।"
( বৈশাখ,১.প্রতীক্ষা,প্রান্তিক চাষা)

হ্যাঁ আমি রুদ্র পতির কবিতাই বলছি। যিনি নিজস্বতা নিজের রচনা শৈলীতে এবং নিজের কবিত্বের বিশ্বাসে অটুট ও আশাবাদী এক বিস্ময়! তাঁর দুরন্ত আগমন, দাপিয়ে বেড়া এবং এক নির্জন সন্ন্যাস আমাদের তাঁর সম্পর্কে অনুসন্ধানে প্রলোভিত করে। 


গ্রাম্য কবি,মেঠো কবি ,চারণ কবি - কবিতার ক্ষেত্রে এ নামগুলি আমাদের কাছে অনেকবার এসেছে ।  বৃহত্তর বাংলা কবিতায় এবং বিশ্ব সাহিত্যে শুধুমাত্র গ্রাম্য জীবন এবং গ্রামকে কেন্দ্র করে কবিতা অনেক লেখা হয়েছে। গানের ক্ষেত্রে সম্প্রতিক সময়ে 'নাগরিক রাখাল' নামে একটি শব্দ-বন্ধ খুব প্রচলিত। আবার চরণ কবি বৈদ্যনাথ বা পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের নামও আমরা অনেক শুনেছি। জসীমউদ্দীনের কবিতায় এই গ্রাম বাংলার যে ছবি ফুটে ওঠে, পল্লী জীবনের মানুষের ছোট খাটো যন্ত্রণা-আনন্দ-ভালবাসা, তা এক কথায় অসামান্য। স্কটল্যান্ড এর বিখ্যাত জাতীয় কবি রবার্ট বার্নসকে প্লাওম্যান পোয়েট বলা হয়। এই প্লাওমেনের সাথে লাঙ্গলের সম্পর্ক ওতপ্রতভাবে জড়িত। ঠিক সেইরকমই নব্বইয়ের দশকের এই কবি নিজেকে অদ্ভুত এক অভিধায় অভিহিত করলেন -'প্রান্তিক চাষা' হিসেবে । নিজেকে ঘোষণা করলেন 'মার্জিনাল পোয়েট' হিসাবে। নিজের জীবনকে এই কথায় তুলে ধরলেন কবিতার আঙিনায়। ভাদরিয়া ঝুমুরের কবি যেমন নিজেদের সুখ দুঃখ নিজেদের সুরে আঙ্গিকে তুলে ধরেন ঠিক তেমনি এই কবি বাংলার অসংখ্য ম্যাগাজিনে লিখলেন ক্ষেতের আলের কথা, গ্রাম নির্ভর ভারতের ভারতবর্ষের কথা,  মুখে ফুঁ দিয়ে লন্ঠনের কাচ মোছার গল্প, বিদ্যুৎহীন ভারতবর্ষের কথা,  খাবার ঘর শোবার ঘর এক করে দেওয়ার কথা - 

"আমাদের খাবারঘর শোবার ঘর একটাই বলে
 ভারতবর্ষের আয়তন ছোট মনে হল" 
(অসহায়তা, এবছর শ্রাবণ ভালো )


রুদ্র পতির কবিতা লেখার শুরুটা আশ্চর্য রকমভাবে হয়েছিল।  কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা মেধাবী ছাত্র রুদ্র পতি বাঁকুড়া শহরের এক কলেজে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়বার জন্য যান। কেমিস্ট্রি সাবজেক্ট পছন্দের হলেও শুধুমাত্র গ্রাম্য জীবন, ভলিবল খেলা, সাঁতার কাটা, এগুলো মিস করার জন্য তিনি চলে আসেন প্রত্যন্ত এক গ্রাম্য কলেজে। শুধু বিষয়ের দিক দিয়ে না, অণু পরমানু এবং মৌলের মধ্যে কবি গভীর ভাবে অনুসন্ধান করেন মানুষের অস্তিত্ব, জীবনের অস্তিত্ব। কবিতায় জীবন এবং কেমিস্ট্রির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন কবিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। প্রথাগত শিক্ষার থেকে কবি বেরিয়ে আসতে থাকেন তাঁর নিজের ভেতরের ভাবনাকে কবিতায় প্রকাশ করার তাড়নায়। ব্যাস শুরু হয় অস্থিরতা, শুরু হয় চাঞ্চল্য। শুরু হয় বিভিন্ন কবিতার ম্যাগাজিন পড়া কবিতা পাঠানো কবিতা লেখা। অনেক কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। কোনো রকম বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বা সমাজ মাধ্যম ছাড়াও শুধুমাত্র চিঠিকে ভিত্তি করে এবং ভারতীয় পোস্ট বিভাগের মাধ্যমে বৃহত্তর বঙ্গের সাথে কবির পরিচয় হতে থাকে। একজন উচ্চ শিক্ষিত হয়ে অধ্যাপক বা কেমিস্ট হওয়ার চেয়ে একজন কবি হওয়া রুদ্র পতির কাছে বেশি বড় মনে হয়। কারণ তরুণ রুদ্র পতির মতে একজন কবির " অনেক বেশি বলার আছে, প্রকাশ করবার আছে, আছে নির্মাণ, আছে পরিব্যপ্ত হওয়ার অসীম ক্ষমতা"( রুদ্র পতি : সাক্ষাৎকার, রাহুল গাঙ্গুলী, তরঙ্গ পরিবার)।


একের পর এক পড়ার বিষয়ে বদল আসলে এক প্রকৃত কবির অস্থিরতার লক্ষণ। একজন কবির মধ্যে সৃষ্টির তাড়নায় এই অস্থিরতা স্বাভাবিক। যদিও আমাদের চাওয়া পাওয়ার জগতে এর মূল্য খুব কম। কবি এই সময় আইটিআই পড়েছেন, কেমিস্ট্রিও পড়েছেন। পাশাপাশি চলেছে সাহিত্য চর্চা, কাব্য দেবীর সাধনা। এই অস্থিরতা এবং কাব্য চর্চার জন্য, পড়াশোনায় বারবার ছেদ পড়ার জন্য, কবির জীবনের নেমে আসে বেকারত্ব।  শিকড়ের টান আরো গভীর হয়। কবিকে আমরা দেখতে পাই ক্ষেতের আলে, কোদাল হাতে। কবি হয়ে ওঠেন একজন প্রান্তিক চাষা।  কেমেস্ট্রি পড়া, আইটিআই এর ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা, বেকারত্ব, গ্রাম্য জীবনের টান, চাষ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, এবং অন্তরের তাড়না,  সৃষ্টি সুখের চাঞ্চল্য, তরুণ যুবক রুদ্র পতির মধ্যে জন্ম দেয় দুটি কাব্যগ্রন্থ -  "প্রান্তিক চাষা"( সিন্ধুসারস প্রকাশনী, হাওড়া, ১৯৯৩) ও  "লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন" (খনন প্রকাশন, নাগপুর, মহারাষ্ট্র ১৯৯৩)। লেদ মেশিনের অসম্ভব ক্ষমতা কবি আশ্চর্য ভাবে দেখেন। কবি আইটিআই পড়ার সময় এই মেশিনের প্রতি আকর্ষিত হন। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যন্ত মানুষের জীবনে, গরিব মানুষের জীবনে কেমিস্ট্রির ব্যবহার তিনি যেভাবে দেখেছেন তাও এক কথায় অনন্য। এই দেখার চোখ একদিকে জীবনে বিজ্ঞান অপরদিকে তেমনি জীবনের করুন ব্যঞ্জনা। কবির কথা অনুযায়ী - 

"আমরা যখন ১৯৮২ সাল তখন হোস্টেলে পড়াশোনা করতাম ক্লাস নাইনে, রাত্রে হোস্টেল সুপারকে না বলেই চলে যেতাম ঝুমুর নাচ দেখতে,  গাজন  পরব  দেখতে, রাত্রে  সেখানে নিভু নিভু আলো জ্বলতো, সেইসব বড় ডিবরির মত  লম্ফ সবই জ্বলতো অ্যাসিটিলিনএর সাহায্যে। সেখানে কেরোসিনের ব্যবহার হতো না তখন। কারণ ক্যালসিয়াম কার্বাইড গুড়ো অনেক কম পয়সায় পাওয়া যেত তাতে জল ঢাললেই এসিটিলিন গ্যাস তৈরি হতো। আশ্চর্য প্রান্তিক গরিব মানুষের জীবন দেখেছি আমি। জীবনে সেই প্রথম কেমিস্ট্রির ব্যবহার চিনেছি। যা হলো অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন " (রুদ্র পতি, হোয়াটস্যাপ )

এই দুই অভিজ্ঞতার কথা "লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন" বইয়ের কবিতায় পাওয়া যায়। এই কবিতাগুলির ছত্রে ছত্রে এক অন্য রকমের শব্দের প্রয়োগ এবং গঠনে কেমিস্ট্রি শব্দ-বন্ধের ব্যবহার খুব কম কবির মধ্যেই আমরা দেখতে পাই। এই কবিতার বইটি সমালোচক মহলে বিশেষ প্রশংসা পায়। 

"লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন" কবিতার বইয়ের প্রতিটি কবিতায় যন্ত্র এবং মানবের এক আশ্চর্য মিলন ঘটেছে।  পাশাপাশি লেদ শ্রমিকদের জীবন সংগ্রামের নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে। এক প্রান্তিক কবি ঘোষণা করেছেন নিজেকে একজন লেদ শ্রমিক হিসাবে -
" মিথ্যে বর্ণমালা। চাষার ছেলে আমি
 বৃষ্টি হীনতায় আজ লেদের শ্রমিক;
 কিছুই চাইনা, শুধু চেয়েছি ভেঙ্গে যেতে।"
(তেজস্ক্রিয়তা, লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন)

আমরা বিনয় মজুমদারের কবিতায় গাণিতিক ভাষার প্রয়োগ দেখেছি। রুদ্র পতির এই কাব্যগ্রন্থে একদিকে যেমন গাণিতিক ভাষা, সিম্বল, বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন শব্দ-বন্ধের প্রয়োগ পাওয়া যায়, তেমনি ক্রমাগত "হার্ড" ও "কংক্রিট ইমেজ" এর ব্যবহার এবং অন্তরে একটি দ্রোহের প্রচ্ছন্ন সুর লক্ষ্য করি।

" দেখি ধোঁয়া, কোলাহল; পতাকায় পতাকায়
 শোষণের পদ্ধতিগুলি
 শুধু বদলে যায়" (রূপান্তর, লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন)

 এই প্রয়োগগুলির মধ্যে কবির ভাষায় মেধার অসম্ভব প্রয়োগ লক্ষ্য করি - 

" গ্রাফাইট এঁকেছে ছবি। ভালোবাসা, তোর মুখ দেখে
 মানুষের বিচ্যুতিগুলি মন থেকে বারবার
 মুছতে চেয়েছি। " ( ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং, লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন)

কিংবা লেদের কংক্রিট মেশিনের পাশেও ফুটে ওঠে এক তরুণ প্রান্তিক চাষার চোখের জল। আষাঢ়ের বৃষ্টির জলে চাষ করতে না পারার আক্ষেপ। একটি ছোট্ট কবিতা সম্পূর্ণ তুলে ধরছি- 

" লেদ মেশিন এর পাশে আষাঢ় এলো...
#
 অনুভূতি আজও মরে যায়নি ব'লে
 কেউ কেউ কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে
 নোংরা হাত দুটি বর্ষা জলে শুদ্ধ ক'রে নেয়
#
 আকাশের দিকে এইমাত্র যে শ্রমিকটি তাকিয়ে ছিল
 তার চোখে জল কেন এলো?!
(আষাঢ়, লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন)

পাশাপাশি একই সময়ে রচিত " প্রান্তিক চাষা " বইটির কবিতাগুলি একটু অন্য ধরনের। ঠিক একই সময়ে এই দুটি বইয়ের কবিতাগুলি লেখা হলেও, এই কবিতার ভাষা খানিকটা আলাদা, যদিও তা কবির নিজস্ব। এই কবিতার বইয়ের প্রায় অধিকাংশ কবিতার বুনন শৈলী অসম লাইন বিন্যাস ও ছোট ছোট অমিল লাইনে বিভক্ত। কবিতাগুলির মধ্যে একটি ব্যাঞ্জনার সুর পরিলক্ষিত। 'আমি' কেন্দ্রিক শব্দের মধ্যে কবি দেখিয়েছেন এক প্রান্তিক চাষার নিজের কথা। এই কবিতার ভাষা তুলনামূলক ভাবে কোমল, নরম, এবং এক প্রচ্ছন্ন রোমান্টিসিজমের সুর অনুভব করা যায়। কিন্তু এই কবিতাগুলির বক্তব্য কখনো অতীব প্রকট নয়। বরং খানিকটা প্রচ্ছন্নই বলা চলে। দুঃখ,বেদনা, ভালবাসা, কোমলতার ছবি ধরা পড়েছে কবিতার ছত্রে ছত্রে। এবং শেষ পর্যন্ত কবিতা গুলি, কবির নিজস্ব কবিতা হয়ে উঠেছে, কিন্তু তা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত হয়ে ওঠেনি- বরঞ্চ সার্বিকতা লাভ করেছে বলা যায়। বেশ কয়েকটি কবিতার লাইন তুলে ধরছি এখানে - 

"যতই তার বিঁধে যাক রাত ও দিনে 
পাখির পাখায় তবু অজস্ৰ বাতাস 

ঠোঁটে ঠোঁটে খড়কুটো, শস্যবীজ রাখা" 
( আবহমান, প্রান্তিক চাষা )

"পৃথিবীর পিঠের ওপর গরু চরাতে গিয়ে এ জন্ম 
বুঝে যায় বাঁশিটির ভেতরে কী ভাবে বিরহ কেঁপে ওঠে।"
(গরু চরাতে গিয়ে, প্রান্তিক চাষা )

সারল্যের চর্চা এবং সাবলীল ভাবে নিজেকে মেলে ধরার ক্ষমতা আপাত দৃষ্টিতে যতটা সহজ অন্তরে ততটাই কঠিন। কবিতার কাছে কবি সৎ না থাকলে, এরকম লেখা যায় না। অথচ এক প্রান্তিক চাষার ছেলে হিসেবে কবি কী অসামান্য দক্ষতায়, এবং একপ্রকার শিশুসুলভ সারল্যে বলতে পেরেছেন - 

"চাষ করি খেটে খাই। এ বছর শ্রাবণ বিমুখ 
তাই দারিদ্র রেখার উপর দিয়ে হেঁটে যাই 
শহরে জন খাটি, এ জনমে নিজ কর্ম করি।
#
গত বছর ধান বিক্রি করে শহর থেকে 
বাবার ধুতি মায়ের কাপড়
কিনে এনেছিলাম 
#
এ বছর স্বপ্নে বহ্নি, তবু বেঁচে থাকি!! স্বপ্নে সপনে "
(প্রান্তিক চাষার ছেলে, প্রান্তিক চাষা )


রুদ্র পতির কবিতা লেখার শুরু যদি আশির দশকের একদম শেষ থেকে ধরা হয় তাহলে নব্বইয়ের গোড়ার কবি রুদ্র পতি। কবির প্রথম দুটি বই এবং ৯৮ সাল পর্যন্ত পর্যায়ে কবি প্রায় তিন হাজার কবিতা লিখেছেন এবং তারপর পরবর্তী বছরগুলিতে ২০০৮ পর্যন্ত কবির দাবি অনুযায়ী আরও তিন হাজার কবিতা লিখেছেন। যদি এই সময়টিকে তাঁর মূল রচনার সময় ধরা হয় তাহলে এই সময়ের রচনা প্রায় ছয় হাজার কবিতা। এই কবিতাগুলি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে, যদিও তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ততটা বেশি নয়। প্রথম দিকে দুটি বইয়ের অনেকদিন পর ২০০৪ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে আরো তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। "বেকারের কবিতা"( ওয়াবী প্রকাশনী,২০০৪), "এ বছর শ্রাবণ ভালো"(কবিতা পাক্ষিক ২০০৪), এবং "গুচ্ছমূল"(লোকসখা প্রকাশনা,২০০৫)।এই তিনটি বইয়ের মধ্যে "বেকারের কবিতা" বইটির কবিতাগুলি অনেক আগে রচিত। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে কবি বেশ কয়েক বছর বেকারত্বের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কবিতাগুলিতে এই বেকার জীবনের প্রতিচ্ছবি, কষ্ট, যন্ত্রণা, এবং সরকার বা ব্যবস্থার প্রতি একটি দ্রোহাত্মক মনভাবে ফুটে উঠেছে। কবি নিজের কথায় অনড় থেকেছেন। কবিতার ভাষা জোরালো হয়েছে, প্রয়োজনে কখনো প্রতিবাদে শব্দের কোমলতা হারিয়েছে।
"আজ সারারাত শুধু প্রতিবাদ 
মদ খাবো?
ব্যবহৃত যোনিতে শুক্র কণাদের 
ব্যাকরণ ভেঙে আজ সারারাত বিরুদ্ধ কিছু করে যাবো
#
আজ সারারাত শুধু প্রতিবাদ 
আবেশের ব্যাকরণ ভেঙে, মদ নয় 
কন্ঠে ঢেলে নেবো গাঢ় অ্যাসিড"
(আজ সারারাত, বেকারের কবিতা)

কবি সাবজেক্টিভ, স্পষ্ট ভাবেই একজন সাবজেক্টিভ কবি, যিনি নিজের যাপনের প্রতিটি স্তরকে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। নিজেকে তুলে ধরতে কোনরকম কুন্ঠাবোধ করেননি। নিজের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন- 

" চাকরি নেই কবিতার বই নেই...
 কাঁথের ওপরেই রোগগ্রস্থ মা, জন্মান্ধ পিসি
 ....
 সংসার জুড়ে হাড়ির ওপরে বেহায়া আগুন"
(ভূমিকা, বেকারের কবিতা)

এই ক্রোধ ঠিক কার প্রতি তা স্পষ্ট নয়। সিস্টেমের বিরুদ্ধে হতে পারে, হতে পারে অসহায়তার জন্য, হতে পারে কিছু করতে না পারার জন্য। আবার হতে পারে নিজের অজ্ঞ দেশবাসীর জন্য, দারিদ্রতার জন্য। এই আগুন খানিকটা অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের ইম্পোটেন্ট এঙ্গারের মতো। যার বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের ভাষা হয়, কিন্তু কিছু সংগঠিত রূপ দিতে পারে না। শেষে এক শূন্য হতাশা রচনা করে।

"আদিবাসী মহিলাটি পা ফাঁক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিসি করে 
তার ব্যাকরণ, বিচ্ছিন্নতার দিকগুলি অজানা থেকে যায় 
শোষণ বুঝলো না সে.…"
(রৌরবে, বেকারের কবিতা)

অথবা কবি লিখেছেন -
" আমার বুকের রক্ত কাঁপে ঘৃণায়, অভিমানে" 
(ভারতবর্ষ, বেকারের কবিতা)

কবির দ্বিতীয় পর্বে লেখা বইগুলির মধ্যে 'এ বছর শ্রাবণ ভালো" খুব গুরুত্বপূর্ণ। কবি 'প্রান্তিক চাষা' বইয়ে যে যাত্রাপথ শুরু করেছিলেন তার পূর্ণতা এই বইয়ের মধ্যে দেখতে পাই। একজন প্রান্তিক জনের অন্তরের কথা প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে এই বইয়ের কবিতাগুলিতে। আগের বইগুলির চেয়ে অপেক্ষাকৃত স্থূলকায় এই বইয়ের কবিতাগুলিতে এক অজানা রোমান্সের সন্ধান পাই। বইয়ের শিরোনামে যে বৃষ্টির সন্ধান তা শুধু ফসল ফলানোয় সীমাবদ্ধ না থেকে এক গ্রাম্য মানুষের সুখ, দুঃখ, আবেগ, অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়া, এবং সর্বপরি এক অজানা ভালোবাসার সন্ধান হয়ে উঠেছে। রয়েছে একটা দুখঃচারণ, যা কখনোই লোক দেখানো প্রকট হয়ে ওঠেনি, বরঞ্চ তা হয়েছে প্রকৃত কবিতা - 
" হাসি ও কান্নার মধ্যে তুমি দেখে নিও 
একটি মাদলের ভালোবাসা, আমার গ্রামীণতা "
(সংসার, এ বছর শ্রাবণ ভালো)

"দুঃখদশা থেকে উঠে আসে তুমুল 
জেল ভাঙা শরৎ এর মোহময় গান "
(শরৎ, এবছর শ্রাবণ ভালো )

"আলতি পাতায় মায়ের চোখের জল;
আজ রুক্ষদিন, তবু দুঃখ করব না।"
(আলতি পাতায়, এ বছর শ্রাবণ ভালো)

অথবা কখনো চাষের আনন্দে প্ৰিয় মুখ হয়েছে সোনালী ধানের ক্ষেত, অথবা জমকালো ভরাট মেঘ -

"তোমার মুখের ওপর সম্ভাবনার আলো 
তোমার চোখের মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি আনুক্রমিক-
হারিত, গাঢ় হারিত, সোনালী 
ধানের বেড়ে ওঠা!" 
(বর্ষমঙ্গল, এ বছর শ্রাবণ ভালো )

ফসলসম্ভবা ক্ষেত প্ৰিয়জনের সাথে জড়িয়ে গেছে প্রাণের গভীরে। এ লাইনগুলিকে রোমান্টিকতা বলবো না তো আর কোন লাইনকে বলবো - 

" বউয়ের দুটি চোখে তখন জ্যোৎস্নারাত 
বউয়ের দুটি চোখে তখন উদ্দীপ্তনার আভা "
(ধানফুল, এ বছর শ্রাবণ ভালো )

"আজ সারারাত চাঁদ তোমার শস্য পাহারায় "
( বন্যাপরবর্তী, এ বছর শ্রাবণ ভালো )

পুরো কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে শুধু প্রান্ত ভূমে ফসল ফলানোর আনন্দ না, সাথে ঘিরে রয়েছে অন্য আরেক মাদকতা, তা হতে পারে, প্রেম, পরিণয়, দুঃখ, গ্রাম্যজীবনের সারল্য, এবং সর্বপরি এক অজানার সন্ধান, এক না পাওয়াকে পাবার আকুল স্মৃতিচারণ -

"করজোড়ে বর্ষণের আকুলতা প্রতিটি রেখায় যেন নদী পাই
প্রতিটি বিন্দুতে জলাশয় ; বহুদিন নৌকা বাইনি, বহুদিন 
ঘাটে লাগেনি তরী। "
(এ বছর শ্রাবণ ভালো, এ বছর শ্রাবণ ভালো )

দ্বিতীয় পর্বে লেখা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই হল "গুচ্ছমূল"। নামকরণ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় কবি এই বইয়ের মধ্যেও কবি সেই শিকড়ের সন্ধান করেছেন, যা তাঁর নিজের। ধানের গাছির নীচে যে গুচ্ছমূল থাকে তাই কবিকে প্রেরণা দেয় সৃষ্টির, সৃজনের - যা ফসল ভর্তি ক্ষেতের মতো কবিকে গর্ভবতী করে। এক সন্তানের জন্ম দেওয়া মায়ের মতোই 'অপান্ডিত্যের' সারল্য নিয়ে কবি রচনা করে যান। আসলে অন্তরের এই অকপট শুদ্ধাচারণ, এইটা নিজেকে পাঠকের কাছে শিশুর মতো মেলে ধরায় যে আনন্দ বর্ষণ হয়, তাই হয়তো শ্রাবণের ধারা, তাই হয়তো ফসলের সুখ, তাই হয়তো প্রান্তিক চোখে 'এপিফ্যানিক' আলোকচ্ছটা - এই আলোর কাছে তথাকথিত সাফল্যের পরিসংখ্যান বড় বেমানান। কবি সেই আবহমানকে বরণ করেছেন, নিজেকে তরলতম করে- 

"লিখি ধামা ভরা চাল, বাটা ভরা পান 
লিখি মাঠ ভরা ধান আর গাছ ভরা আম 
...    ....   ....   ....   .... 
বেঁচে উঠুক লোকগান আবহমান বাংলা কবিতার ধারা "
( আনন্দ, গুচ্ছমূল)

গ্রাম্যজীবনের প্রতিচ্ছবি কবির কবিতায় যেভাবে ফুটে উঠেছে তা এককথায় অসামান্য। এই কবিতা পাঠের পর অন্য এক জগতে নিয়ে যায় - 

" ঝিঙে ফুল ফুটে ওঠে ভাদ্র শেষের গোধূলি আভায় 
সন্ধ্যা হলো মাগো 
তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানোর সময় হলো 
শাঁখে ফুঁ রাত্রের সমস্ত অমঙ্গলের বিরুদ্ধে "
(নিরীক্ষণ করে দেখি, গুচ্ছমূল )

বিজ্ঞানের শব্দের ব্যবহার, একদম গ্রাম্য শব্দের পাশাপাশি এক অদ্ভূত বৈপরিত্য সূচিত করেছে, যেমন ফসলের সাথে মিশে গেছে প্রিয়তমা শরীরে, এ যেন যাপিত-জীবন কবিতা-জীবনর সাথে বিশুদ্ধ সঙ্গমে লীন - 

"দশমিক ডান পাশে দিয়ে তোমার মান বাড়িয়ে দিই 
যখন ধানফুল হাওয়ায় এবং জলে ভেসে যায় 
এবং ধানের থোড় তার সম্পূর্ণতা প্রকাশ করেছে দেখলাম 
সফল এ জন্মে তাই জ্যোৎস্না প্রভাবিত 
ধানফুল তোমার উঠোনে তোমার বিছনায় এসে পড়ে 
ধীরে ধীরে তোমার নিপিলের চারপাশ কালো হয় 
ভেলা পড়ে 
শরীরে শরীর জাগে "
(দশমিক বিন্দুর ব্যবহার, গুচ্ছমূল )

চাষার জীবনে শুধু আনন্দ না, অভাবের আঁধার, ভাদরের কষ্টের দিন বড় সত্যি। এই সত্যকে কবি উপেক্ষা করে যান নি। বড় স্পষ্ট করে লিখে গেছেন। তিনটে কবিতার কিছু পঙক্তি তুললাম এখানে - 

"টানের সংসার।গোরু দুটি বিক্রি করা ছাড়া আর উপায় রইল না।
খড় নেই, মাটিও পুড়ে লাল..."
( অভিমান, গুচ্ছমূল )

"পাগল করা খিদে এলো। ভাদ্র মাস হাহাকার তোলে;
দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দোকানি চলেছে দূরে 
খরিদ্দারেরা আগেই চলে গিয়েছে পুব দিকে, শহরে...."
(শরৎ, গুচ্ছমূল )

"বাড়িতে চাল নেই ভাদ্রমাস কৃষকের গ্রাম 
গ্রামে বসত করে চাল ফুরিয়েছে বলতে নেই 
তাই মা বলে - চাল বেড়েছে 
এতে নাকি মা লক্ষ্মী খুশি হন..."
(ভয়, গুচ্ছমূল )

প্রান্তিক কবি রুদ্র পতি আত্মজৈবনিক, সাবজেক্টিভ, এবং অবশ্যই রোমান্টিক। তিনি নিজের জীবনকেই তুলে ধরেছেন, ধার ধরেন নি স্মার্ট কবিতার, বা চটকদারি লাইন বা শব্দের ব্যবহারে। এখানেই কবিতার জয়, এখানেই সার্থকতা। কবির এই কবিতার অংশ পড়ে থেমে যেতে হবে যে কোনো নিবিড় পাঠককে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত - 

"আলো এসে ফিরে গেল আমরা দুজনাই 
ধরতে পারলাম না, তাই অন্ধকারে ডুবে যায় বসত
আমার জন্মান্ধ জ্যাঠা ও পিসির  চোখে আলো নেই 
শুধু অনুমানে পথ চলে যেমন উইপোকা অথবা কেঁচো "
(ক্ষত, গুচ্ছমূল )


"গুচ্ছমূল" কাব্যগ্রন্থের পর কবির আর কোনো কবিতার বই প্রকাশ পায় নি। তিনি লিখে গেছেন কিন্তু প্রকাশের গতি মন্থর হয়েছে। কবির তরুণ বয়সে প্রকাশের আনন্দ শিথিল হয়েছে। মাঝে বেশ কয়েক বছর কবি একটা স্বেচ্ছা নির্বাসনও নিয়েছেন ।এক অদ্ভুত উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে কবির মধ্যে। ২০১৬-১৭ সালের পর থেকে কবিকে আরও নতুন ভাবে দেখা যায়। প্রশ্ন একটাই, সেই পুরনো কবিকে আমরা কী পাবো আবার নতুন ভাবে, নতুন রূপে? এখন শুধু এটুকু বলার কবি মুছে যায় না, তাঁর কবিতাগুলিও ফিনিক্স পাখির মতো প্রতি শ্রাবণে আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এই সে অমরত্ব, এই সে আবহমান!


সূত্র :
১.প্রান্তিক চাষা, সিন্ধুসারস প্রকাশনী, হাওড়া, ১৯৯৩
২.লেদ অথবা অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন, খনন প্রকাশন, নাগপুর, মহারাষ্ট্র, ১৯৯৩
৩.বেকারের কবিতা, ওয়াবী প্রকাশনী, আসনবনী, বাঁকুড়া ২০০৪
৪.এ বছর শ্রাবণ ভালো, কবিতা পাক্ষিক, কলকাতা, ২০০৪
৫.গুচ্ছমূল, লোকসখা প্রকাশনা, কলকাতা,  ২০০৫
৬.রুদ্র পতি : সাক্ষাৎকার, রাহুল গাঙ্গুলী, তরঙ্গ পরিবার https://tarangahouse.blogspot.com/2017/11/blog-post_96.html?m=1
৭. মেঠো কবিতা,  নিশীথ রায় চৌধুরী, প্রান্তিক ৬৭-৬৮, ২০০৬
৮. হোয়াটস অ্যাপ কথাপোকথন, রুদ্র পতি- সুপ্রিয় দেওঘরিয়া,২০২৪

অসুর: এক পরাজিত জাতির ইতিহাস

অসুর: এক পরাজিত জাতির ইতিহাস 

রূপায়ণ ঘোষ 

ভারত দেশটি যেমন বিপুল তেমনই সমৃদ্ধশালী তার ইতিহাস। নানান শাখা-প্রশাখায় সে ইতিহাসের ভিতর ছড়িয়ে রয়েছে অফুরান ঘটনা এবং তাদের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা। ভারতভূমির তেমনই এক অনালোচিত অধ্যায়- অসুর জাতির অকথিত, বিলুপ্তপ্রায় ইতিহাস।  আরও পরিষ্কার ভাবে বললে, ভারতবর্ষে বৈদিক সভ্যতার সূত্রপাত ঘটে সপ্তসিন্ধুর পূর্বাংশে সরস্বতী নদীকে কেন্দ্র করে। এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ ভাষ্যকার সায়নাচার্য বলেছেন, সমগ্র ঋগ্বেদে সরস্বতীকে 'দেবীতমাঃ' অর্থাৎ পবিত্রতম বা দেবী মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে সিন্ধু অথবা গঙ্গার এই প্রকার বিপুল ঐশ্বরিক স্তুতি ঋকবেদের কোথাও সেভাবে স্থান পায়নি। ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের আশেপাশে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে কৃষিভিত্তিক যে সভ্যতার সূচনা ঘটে; ঋগ্বেদ তার সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক উপাদান। ফলে পশুপালনবৃত্তিকারী এই গোষ্ঠীর যাবতীয় কার্যক্রম যে সরস্বতী নদীকে কেন্দ্র করে ছিল তা বলাই বাহুল্য। 

এই বেদপন্থী আর্যগোষ্ঠীরা মূলত 'দেব' ও 'অসুর' এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। হ্যাঁ, অসুর বলতে যে ধারণা বর্তমানে আমরা পোষণ করি তা সর্বৈব মিথ্যা এবং ভ্রান্ত। বিষ্ণুপুরাণের প্রথম সর্গের পঞ্চম অধ্যায়ে ব্যক্ত আছে,  সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার জঘন-দেশ (জঙ্ঘা) থেকে তমোগুণ সম্পন্ন অসুরদের জন্ম হয় রাত্রির অন্ধকারে। অন্যদিকে দিনের বেলায় ব্রহ্মার সত্ত্বোদ্রিক্ত অবস্থায় সাত্ত্বিকগুণ সম্পন্ন দেবতাদের জন্ম হয়- অর্থাৎ একই ব্যক্তি থেকে এই দুই গোষ্ঠীর উদ্ভব। এখন পুরাণের এই অতিরঞ্জিত গল্পকে সরিয়ে রাখলে, বাস্তব বুদ্ধিতে যে তত্ত্বটি সামনে আসে, তা হল একই গোষ্ঠীপতির ভিন্ন ভিন্ন পত্নী হতে উৎপন্ন দুই বৈমাত্রেয় ভাই হল দেব এবং অসুর। পরবর্তীতে যাঁঁরা নিজ নিজ দল বা গোষ্ঠীকে একটি বৃহৎ সম্প্রদায়ের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময় থেকেই বৈদিক আর্যদের মধ্যে অগ্নিপূজার প্রচলন ঘটে।  প্রথমদিকে দেব ও অসুর উভয়পক্ষই অগ্নিপূজা বা যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতেন; পরবর্তীতে মতান্তর এবং তা থেকে এক সার্বিক আদর্শ (Ideology) তথা সম্প্রদায়গত মনান্তরেরও সৃষ্টি হয় যাতে অসুরেরা যজ্ঞপ্রথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

খুব সম্ভবত এই বিচ্ছিন্নতার কারণ ছিল দেবতাদের পদস্খলন এবং আদর্শগত চ্যুতি। বৈদিক যুগের প্রথম পর্বে আর্যরা ছিল কৃষি ও পশুপালক জাতি। ফলে বৃষ, গাভী, বলদ, অশ্ব জাতীয় মূল্যবান পশুর যথেষ্ট জোগান তাঁঁদের ছিল এবং এই পশুসম্পদকে রক্ষা করার প্রবণতা অল্পকালের মধ্যেই ভারতে তাঁঁদের পায়ের তলার মাটিকে সশক্ত করে তোলে। কিন্তু পরবর্তীকালে যজ্ঞপ্রথা (Sacrifice) উদ্ভাবনের সাথে সাথে এই পশুসম্পদকে তাতে উৎসর্গ বা বলি দেওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। সম্ভবত অসুরগোষ্ঠী পশুসম্পদের এই অনৈতিক হানি ও সমাজের উচ্চপ্রভাবশালীবর্গের এমন কুকর্মকে সমর্থন করেনি। (লক্ষ করলে দেখা যাবে, জীবনধারণের জন্য শিকারবৃত্তি অবলম্বন করলেও বন্য জনজাতির মধ্যে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে শত শত পশুবলি দেওয়ার রীতি প্রায় নেই বললেই চলে) পাশাপাশি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের মতো গোষ্ঠীগত কোনও মতানৈক্যের কারণেই দেব এবং অসুর আলাদা হয়ে পড়ে। অতঃপর ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বপ্রথম ক্ষমতাতান্ত্রিক লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে। 

বেদে ১০৫ বার 'অসুর' শব্দের প্রয়োগ আছে, বলা বাহুল্য সবই ভালো বা উত্তম অর্থে প্রযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে যতদিন উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় ছিল ততদিন দেবতারা অসুর শব্দকে মর্যাদাব্যঞ্জক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মরুৎ, বরুণ, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবতারা বেদের প্রথমকালে বারংবার 'অসুর' সম্মানসূচক পদে ভূষিত হয়েছেন। মরুতের জন্য ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, 

"তে জজ্ঞিরে দিব ঋষ্বাস উক্ষণো রুদ্রস্য মর্যাসুরাঃ অরেপসঃ।" (ঋ: ১.৬৪.২)

বরুণ- "ত্বং বিশ্বেষাং বরুণাসি রাজা যে চ দেবা অসুর যে চ মর্তাঃ।" (ঋ: ২.২৭.১০)

অগ্নি- "প্রাগ্নয়ে বৃহতে যজ্ঞিয়ায় ঋতস্য বৃষ্ণে অসুরায় মম্ম।" (ঋ: ৫.১২.১)

বায়ু- "শৃণোত্বতূর্তপংথা অসুরো ময়োভূঃ"। (ঋ: ৫.৪২.১) 

 

কিন্তু নৈতিক দ্বন্দ্বের আরম্ভ হতেই সর্বপ্রকার সৌহার্দ্য সরে গিয়ে ঘৃণা ও ঈর্ষা প্রধান হয়ে দাঁড়ালো। পুরাণের ব্যাখ্যা অনুযায়ী 'অসুর' শব্দটির উৎপত্তি 'অসু' থেকে যার অর্থ প্রাণ। বায়ুপুরাণের নবম অধ্যায়েও অসুরদের উৎপত্তির কারণ হিসেবে ব্রহ্মাকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে- 

 

''ততোহস্য জঘনাৎ পূর্বমসুরা জজ্ঞিরে সুতাঃ।

 অসুঃ প্রাণঃ স্মৃতো বিপ্রাস্তজ্জন্মানস্ততোহসুরাঃ।।"

 

সুতরাং অসুর অর্থে সমস্ত অনার্য জাতি অশুভ কিংবা অমঙ্গলকারী এমন ভ্রান্ত ধারণার কোন যুক্তিই ধোপে টেকে না। কিন্তু যুগ যুগ ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্য এবং চিন্তা-চেতনা ক্রমাগত প্রচারের মাধ্যমে একটি মিথের প্রতিষ্ঠা দিতে সক্ষম হয়েছে- তা হল দেব-বিরুদ্ধ যে কোনও শক্তিই অশুভ, ভয়ঙ্কর, অনিষ্টকারী। কিন্তু এ বিচার তো কেবল দেবতাদের দৃষ্টিকোণ থেকে; যদি বেদ-পুরাণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলিকে আতশ কাচের তলায় ফেলা যায় তবে দেখা যাবে, দেবতাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ইন্দ্র পদাধিকারী শাসকেরাই সর্বাধিক অশুভ, অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংযুক্ত। গৌতমপত্নী অহল্যার সম্মানহানিই হোক কিংবা অমৃতভাগের সময় অসুরদের প্রবঞ্চনা- প্রতিটি ক্ষেত্রে দেবশাসক ইন্দ্রের অনৈতিক, স্বার্থান্বেষী চরিত্রটি সামনে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অবশিষ্ট দেবগোষ্ঠীও তাঁঁদের এই কুকর্মের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে সমস্ত রকম সহায়তা ইন্দ্রদেরকে (ইন্দ্রত্ব একটি পদ, কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়) প্রদান করেছে। সুতরাং দেব মাত্রই শুভ এবং অসুর অশুভ শক্তির প্রতীক- এটি একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী মনগড়া কাহিনি বা কুসংস্কার ব্যতীত আর কিচ্ছু না। 

বৈদিক যুগের শেষ পর্বে অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ অসুররা দেবতাদের থেকে পৃথক হয়ে পড়ে এবং ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে পারস্য (বর্তমান ইরান) অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এমতাবস্থায় দেবার্যরা (যেহেতু দেব এবং অসুর উভয়েই আর্য, তাই আমরা এদের ভাগদুটিকে দেবার্য ও অসুরার্য বলব।) সপ্তসিন্ধুসহ সরস্বতীর পূর্বদিকে বেশ কিছুটা অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হয়। যে সমস্ত অসুরেরা ভারতের বাইরে যেতে পারল না, তাঁঁরা ক্রমাগত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে হটতে ভারতের একেবারে পূর্বাংশে অরণ্যঘেরা ভূখণ্ডে এসে উপস্থিত হলো।  ছোটনাগপুর, ঝাড়খণ্ড, সিংভূম, ধলভূম-এর মতো বিস্তীর্ণ মালভূমি ও দুর্ভেদ্য অরণ্যাঞ্চল সেই মুহূর্তে দুর্বল, ছত্রভঙ্গ, রণক্লান্ত অসুরগোষ্ঠীর কাছে আত্মগোপনের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত স্থান হিসেবে যে বিবেচ্য হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

 

অন্যদিকে যেসব অসুরগোষ্ঠী ভারতের বাইরে যেতে সক্ষম হয়েছিল ক্রমে তাঁঁদের প্রভাব ও পরাক্রম এত ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যে প্রায় তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে ব্যাবিলনের কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমাংশে তাঁঁরা অসুর বা আসিরিয়া(Assyria) নামে একটি সুবিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করে। টাইগ্রিস নদীর উর্বর উপকূল অঞ্চলে গড়ে ওঠে এদের সুরম্য রাজধানী। এশিয়া মাইনর থেকে ককেসাস্ পর্বত পর্যন্ত এদের অধিকার বিস্তৃত হয়। এই আসিরীয় জাতির প্রাচীন সভ্যতার যে নিদর্শন পাওয়া যায় (মেসোপটেমিয়া অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত তাম্রনির্মিত সুরাপাত্র, এছাড়া ভাষাসমূহের ব্যবহার) তাতে প্রমাণ করা যায় এই সভ্যতা অনেকাংশেই সুমেরীয়দের কাছে ঋণী। অনেক  ঐতিহাসিকদের মতে, সুমেরীয়রাই দ্রাবিড় জাতির বিবর্তিত রূপ, অন্তত উভয় জাতির ব্যবহৃত ভাষা ও লিপিসমূহে তেমনই ইঙ্গিত মেলে। একটা বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে দ্রাবিড়রা ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন জনজাতি। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ Sir William Turner প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রমাণ করেছেন যে, দ্রাবিড়রা বহু আদিমকাল থেকেই ভারতবর্ষের অধিবাসী। সেক্ষেত্রে অসুর সভ্যতার একটি বৃহদাংশ যে প্রাচীন ভারতীয় জনজাতি এবং বহিরাগত আর্যরা তাঁঁদের পরাজিত করে ভারতের বিস্তীর্ণ ভূমিভাগ দখল করেন- এ তত্ত্ব যথেষ্ট প্রামাণিক বলে বোধ হয়।ব্যাবিলনের ল্যাগেশ নগরের তেল্লা(Tella) নামক স্থানে মাটির স্তূূপ থেকে কারুকার্যখচিত যে প্রাচীন রূপোর পাত্র, তাম্রদ্রব্য আবিষ্কৃত হয়- ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণাংশে অরণ্যাঞ্চল থেকে সেই একই আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সমন্বিত তাম্রযন্ত্র উদ্ধার হয়েছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সেখানকার স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, সেখানে অসুর জনজাতির রাজা মহিষাসুরের শাসন ছিল; খুব সম্ভবত আরও দক্ষিণে মহীশূর ছিল তাঁঁর রাজধানী। সপ্তসিন্ধু থেকে বিতাড়িত হয়ে অসুুুর সম্প্রদায় দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের গঙ্গা বিধৌত অরণ্যভূমিকে নিজেদের বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সেখানে ভারতের সবচেয়ে আদিম অনার্য জনজাতি কোল, ভিল, হো, মুুুণ্ডাদের সঙ্গে অসুরদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় একটি মিশ্র সংকর জাতির উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে হয়। কালক্রমে তাঁঁরা আবিষ্কার করল এই বিপুল বনাঞ্চল আসলে খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। বিশেষত লৌহ, তাম্র, স্বর্ণ, বক্সাইটের অজস্র খনি যে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একথা আজ আর কারোর অজানা নয়। অন্যদিকে গঙ্গার পলিযুক্ত উর্বর কৃষিভূমি ছিল আরেক লোভনীয় সম্পদ। এই সকল অফুরান বৈভবের মাঝে অসুদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা দেবতাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। মরু-অঞ্চল যুক্ত রাজস্থান, গুজরাট এবং বৃহৎ নদীহীন উত্তর-পশ্চিম ভারতে দেবতাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছিল। পুরাণে বর্ণিত দেবতাদের শ্রীহীন হওয়া ও দেবী লক্ষ্মীর পাতাল-প্রবেশ এই ঘটনাকেই সমর্থন করে। সমুদ্রমন্থন করে লক্ষ্মীর পুনরায় স্বর্গে ফেরত আসা স্রেফ একটা গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া কিছু নয়। অসুরদের দ্বারা মরু-অঞ্চল যুক্ত বৃহৎ নদীহীন, কৃষিহীন উত্তর-পশ্চিম ভারত (পুরাণে বর্ণিত অমরাবতী/স্বর্গ) আক্রমণের কোন যুক্তিযত কারণ পাওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে আজকের দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব অঞ্চলগুলি তৎকালীন সময়ে এত উন্নত ও জনাকীর্ণ ছিল না। বরং গঙ্গা-দোয়াবাঞ্চলের কৃষিজমি, বনজ সম্পদশালী ভূভাগ এবং বিপুল খনিজ ভাণ্ডারের লোভে দেবতাদের দ্বারা বারংবার অসুররাজ্য (দক্ষিণ-পূর্ব ভারত) আক্রমণের তত্ত্বটি অনেকবেশি যুক্তিসম্মত বলে মনে হয়। এমনই একটি লোকশ্রুতি- যা মধ্যপ্রদেশ, বাংলার উত্তরবঙ্গ, সিংভূম, ছোটনাগপুর অঞ্চলগুলিতে বহুলভাবে প্রচলিত তাতে জানা যায় সিংভূম থেকে গাংপুর স্টেট পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ তাম্রখনি (যা প্রত্নতত্ত্ববিদরা ১৯৪০-এর দশকে আবিষ্কার করেন) ছিল মহিষাসুরের শাসনাধীনে।  আজও স্থানীয় লোকেরা একে 'অসুরগড়' বলে উল্লেখ করে। এই বিস্তৃত অঞ্চল জবরদখলের জন্য দেবতারা বারবার আক্রমণ করলেও অসুরদের হাতে পরাজিত হয়। তখন উপায়ন্তর না দেখে 'দুর্গা' নামক এক রমণীর সাহায্য তাঁঁরা গ্রহণ করে। এই দুর্গা ছলে-বলে-কৌশলে-রূপে-দেহসৌন্দর্য্যৈ বীর অসুররাজকে প্রণয়াসক্ত করতে সক্ষম হয় এবং গভীর অরণ্য মাঝে সোহাগরত অবস্থায় নিরস্ত্র, অসতর্ক মহিষাসুরকে হত্যা করে। সেই কারণেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসুর জাতির লোকেরা আজও দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে আলো বন্ধ করে অন্ধকার রাত্রিতে ছিন্ন পোশাক পরিহিত হয়ে অশৌচ ও শোক পালন করেন। 

 

এই মহিষাসুরের সঙ্গে আসিরীয় সম্রাট অসুরবনিপালের যোগসূত্রকেও উড়িয়ে দেওয়া চলে না। প্রায় ৬৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে বিপুল পরিমাণ তামা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো, আসিরীয়রা তাম্র-প্রিয় জাতি তো ছিলই, তাঁঁদের ব্যবহৃত তাম্র-দ্রব্যে ভারতীয় তামার নানান বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করা গেছে। ভারত ও আসিরীয় অসুররা যে একই জাতি তা আরও কিছু তথ্য সহকারে প্রমাণ করা সম্ভব। প্রথমত, আসিরীয় অসুর সম্প্রদায়ের শ্মশান ছিল ডিম্বাকৃতি মৃৎপাত্রের মতো, স্থানে স্থানে গোলাকার। অন্যদিকে শতপথ-ব্রাহ্মণে দেখা যায় দেবতাদের শ্মশান ছিল বর্গক্ষেত্র, স্থানে স্থানে আয়তাকার। কিন্তু ভারতীয় অসুরদের শ্মশান ছিল গোলাকৃতি। 

 

"যা আসুর্য প্রাচ্যাস্ত্বদ যে ত্বৎ পরিমণ্ডালানি শ্মশানানি কুর্বতে।" 

                                                       - শতপথ-ব্রাহ্মণ (১৩.৪.১.৫) 

 

দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক Sclater ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসরণ করে দেখিয়েছেন, যে একজাতীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীদের পৃথিবীর পৃথক পৃথক ভূখণ্ডে থাকা সম্ভব নয়। হয় বিচ্ছিন্ন ভূ-খণ্ডগুলি সংযুক্ত ছিল অথবা একই সম্প্রদায়ভুক্ত প্রাণীর উৎসভূমি একটিই;  পরবর্তীতে হতে পারে জীবনচর্যার তাগিদে তাঁঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত থেকে রপ্তানিকৃত যে খনিজ ও বনজ সম্পদ আসিরীয় সাম্রাজ্যের জৌলুসকে মহামান্বিত করে তুলতে পারে; সেই বিপুল ধনভাণ্ডার ভারতীয় অসুর জাতিকে নিশ্চয়ই দরিদ্রতা দান করেনি। বরং অনেকবেশি বৈভব ও বিত্তের অধিকারী করে তুলেছিল। প্রকৃতপক্ষে এই অতুল ঐশ্বর্যের চমকে দেবগণের দ্বিতীয়বার পদস্খলন হয়। ফলস্বরূপ তারা প্রতিনিয়ত অসুরগোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে থাকে, বীরত্বের বদলে ছলনা ও মিথ্যাচারিতার আশ্রয় নিয়ে তাদের পরাজিত এবং বিতাড়িত করতেও সক্ষম হয়। নির্মিত হয় বিস্তৃত আর্যাবর্ত ও তার নিজস্ব ইতিহাস।  যাকে ধর্মগ্রন্থের রূপ দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে সমাজের একটি ঐতিহাসিক দিককে আবৃত করে রাখা হয়েছে। কারণ শত অপরাধ, অন্যায় সত্ত্বেও ইতিহাস এবং সমাজ, অস্ত্র তথা বিজয়ীর কর্তৃত্বকেই সর্বদা স্বীকার করে এসেছে।। 

 

                                     

 

তথ্যসূত্র: 

১. ঋগ্বেদ, অনুবাদ- রমেশচন্দ্র দত্ত।

২. Indian Malayia: contribution to the Carniology of the people of the empire of India, Sir William Turner 

৩. History of ancient indian religious texts, J.R. Carter

৪. Perspective in social and economic history of early India, R.S. Sharma 

৫. রচনাবলী (প্রথমখণ্ড), অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। 

৬. দেবতার মানবায়ন, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী।