অসুর: এক পরাজিত জাতির ইতিহাস

অসুর: এক পরাজিত জাতির ইতিহাস 

রূপায়ণ ঘোষ 

ভারত দেশটি যেমন বিপুল তেমনই সমৃদ্ধশালী তার ইতিহাস। নানান শাখা-প্রশাখায় সে ইতিহাসের ভিতর ছড়িয়ে রয়েছে অফুরান ঘটনা এবং তাদের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা। ভারতভূমির তেমনই এক অনালোচিত অধ্যায়- অসুর জাতির অকথিত, বিলুপ্তপ্রায় ইতিহাস।  আরও পরিষ্কার ভাবে বললে, ভারতবর্ষে বৈদিক সভ্যতার সূত্রপাত ঘটে সপ্তসিন্ধুর পূর্বাংশে সরস্বতী নদীকে কেন্দ্র করে। এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ ভাষ্যকার সায়নাচার্য বলেছেন, সমগ্র ঋগ্বেদে সরস্বতীকে 'দেবীতমাঃ' অর্থাৎ পবিত্রতম বা দেবী মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে সিন্ধু অথবা গঙ্গার এই প্রকার বিপুল ঐশ্বরিক স্তুতি ঋকবেদের কোথাও সেভাবে স্থান পায়নি। ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের আশেপাশে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে কৃষিভিত্তিক যে সভ্যতার সূচনা ঘটে; ঋগ্বেদ তার সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক উপাদান। ফলে পশুপালনবৃত্তিকারী এই গোষ্ঠীর যাবতীয় কার্যক্রম যে সরস্বতী নদীকে কেন্দ্র করে ছিল তা বলাই বাহুল্য। 

এই বেদপন্থী আর্যগোষ্ঠীরা মূলত 'দেব' ও 'অসুর' এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। হ্যাঁ, অসুর বলতে যে ধারণা বর্তমানে আমরা পোষণ করি তা সর্বৈব মিথ্যা এবং ভ্রান্ত। বিষ্ণুপুরাণের প্রথম সর্গের পঞ্চম অধ্যায়ে ব্যক্ত আছে,  সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার জঘন-দেশ (জঙ্ঘা) থেকে তমোগুণ সম্পন্ন অসুরদের জন্ম হয় রাত্রির অন্ধকারে। অন্যদিকে দিনের বেলায় ব্রহ্মার সত্ত্বোদ্রিক্ত অবস্থায় সাত্ত্বিকগুণ সম্পন্ন দেবতাদের জন্ম হয়- অর্থাৎ একই ব্যক্তি থেকে এই দুই গোষ্ঠীর উদ্ভব। এখন পুরাণের এই অতিরঞ্জিত গল্পকে সরিয়ে রাখলে, বাস্তব বুদ্ধিতে যে তত্ত্বটি সামনে আসে, তা হল একই গোষ্ঠীপতির ভিন্ন ভিন্ন পত্নী হতে উৎপন্ন দুই বৈমাত্রেয় ভাই হল দেব এবং অসুর। পরবর্তীতে যাঁঁরা নিজ নিজ দল বা গোষ্ঠীকে একটি বৃহৎ সম্প্রদায়ের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময় থেকেই বৈদিক আর্যদের মধ্যে অগ্নিপূজার প্রচলন ঘটে।  প্রথমদিকে দেব ও অসুর উভয়পক্ষই অগ্নিপূজা বা যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতেন; পরবর্তীতে মতান্তর এবং তা থেকে এক সার্বিক আদর্শ (Ideology) তথা সম্প্রদায়গত মনান্তরেরও সৃষ্টি হয় যাতে অসুরেরা যজ্ঞপ্রথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

খুব সম্ভবত এই বিচ্ছিন্নতার কারণ ছিল দেবতাদের পদস্খলন এবং আদর্শগত চ্যুতি। বৈদিক যুগের প্রথম পর্বে আর্যরা ছিল কৃষি ও পশুপালক জাতি। ফলে বৃষ, গাভী, বলদ, অশ্ব জাতীয় মূল্যবান পশুর যথেষ্ট জোগান তাঁঁদের ছিল এবং এই পশুসম্পদকে রক্ষা করার প্রবণতা অল্পকালের মধ্যেই ভারতে তাঁঁদের পায়ের তলার মাটিকে সশক্ত করে তোলে। কিন্তু পরবর্তীকালে যজ্ঞপ্রথা (Sacrifice) উদ্ভাবনের সাথে সাথে এই পশুসম্পদকে তাতে উৎসর্গ বা বলি দেওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। সম্ভবত অসুরগোষ্ঠী পশুসম্পদের এই অনৈতিক হানি ও সমাজের উচ্চপ্রভাবশালীবর্গের এমন কুকর্মকে সমর্থন করেনি। (লক্ষ করলে দেখা যাবে, জীবনধারণের জন্য শিকারবৃত্তি অবলম্বন করলেও বন্য জনজাতির মধ্যে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে শত শত পশুবলি দেওয়ার রীতি প্রায় নেই বললেই চলে) পাশাপাশি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের মতো গোষ্ঠীগত কোনও মতানৈক্যের কারণেই দেব এবং অসুর আলাদা হয়ে পড়ে। অতঃপর ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বপ্রথম ক্ষমতাতান্ত্রিক লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে। 

বেদে ১০৫ বার 'অসুর' শব্দের প্রয়োগ আছে, বলা বাহুল্য সবই ভালো বা উত্তম অর্থে প্রযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে যতদিন উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় ছিল ততদিন দেবতারা অসুর শব্দকে মর্যাদাব্যঞ্জক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মরুৎ, বরুণ, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবতারা বেদের প্রথমকালে বারংবার 'অসুর' সম্মানসূচক পদে ভূষিত হয়েছেন। মরুতের জন্য ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, 

"তে জজ্ঞিরে দিব ঋষ্বাস উক্ষণো রুদ্রস্য মর্যাসুরাঃ অরেপসঃ।" (ঋ: ১.৬৪.২)

বরুণ- "ত্বং বিশ্বেষাং বরুণাসি রাজা যে চ দেবা অসুর যে চ মর্তাঃ।" (ঋ: ২.২৭.১০)

অগ্নি- "প্রাগ্নয়ে বৃহতে যজ্ঞিয়ায় ঋতস্য বৃষ্ণে অসুরায় মম্ম।" (ঋ: ৫.১২.১)

বায়ু- "শৃণোত্বতূর্তপংথা অসুরো ময়োভূঃ"। (ঋ: ৫.৪২.১) 

 

কিন্তু নৈতিক দ্বন্দ্বের আরম্ভ হতেই সর্বপ্রকার সৌহার্দ্য সরে গিয়ে ঘৃণা ও ঈর্ষা প্রধান হয়ে দাঁড়ালো। পুরাণের ব্যাখ্যা অনুযায়ী 'অসুর' শব্দটির উৎপত্তি 'অসু' থেকে যার অর্থ প্রাণ। বায়ুপুরাণের নবম অধ্যায়েও অসুরদের উৎপত্তির কারণ হিসেবে ব্রহ্মাকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে- 

 

''ততোহস্য জঘনাৎ পূর্বমসুরা জজ্ঞিরে সুতাঃ।

 অসুঃ প্রাণঃ স্মৃতো বিপ্রাস্তজ্জন্মানস্ততোহসুরাঃ।।"

 

সুতরাং অসুর অর্থে সমস্ত অনার্য জাতি অশুভ কিংবা অমঙ্গলকারী এমন ভ্রান্ত ধারণার কোন যুক্তিই ধোপে টেকে না। কিন্তু যুগ যুগ ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্য এবং চিন্তা-চেতনা ক্রমাগত প্রচারের মাধ্যমে একটি মিথের প্রতিষ্ঠা দিতে সক্ষম হয়েছে- তা হল দেব-বিরুদ্ধ যে কোনও শক্তিই অশুভ, ভয়ঙ্কর, অনিষ্টকারী। কিন্তু এ বিচার তো কেবল দেবতাদের দৃষ্টিকোণ থেকে; যদি বেদ-পুরাণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলিকে আতশ কাচের তলায় ফেলা যায় তবে দেখা যাবে, দেবতাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ইন্দ্র পদাধিকারী শাসকেরাই সর্বাধিক অশুভ, অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংযুক্ত। গৌতমপত্নী অহল্যার সম্মানহানিই হোক কিংবা অমৃতভাগের সময় অসুরদের প্রবঞ্চনা- প্রতিটি ক্ষেত্রে দেবশাসক ইন্দ্রের অনৈতিক, স্বার্থান্বেষী চরিত্রটি সামনে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অবশিষ্ট দেবগোষ্ঠীও তাঁঁদের এই কুকর্মের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে সমস্ত রকম সহায়তা ইন্দ্রদেরকে (ইন্দ্রত্ব একটি পদ, কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়) প্রদান করেছে। সুতরাং দেব মাত্রই শুভ এবং অসুর অশুভ শক্তির প্রতীক- এটি একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী মনগড়া কাহিনি বা কুসংস্কার ব্যতীত আর কিচ্ছু না। 

বৈদিক যুগের শেষ পর্বে অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ অসুররা দেবতাদের থেকে পৃথক হয়ে পড়ে এবং ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে পারস্য (বর্তমান ইরান) অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এমতাবস্থায় দেবার্যরা (যেহেতু দেব এবং অসুর উভয়েই আর্য, তাই আমরা এদের ভাগদুটিকে দেবার্য ও অসুরার্য বলব।) সপ্তসিন্ধুসহ সরস্বতীর পূর্বদিকে বেশ কিছুটা অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হয়। যে সমস্ত অসুরেরা ভারতের বাইরে যেতে পারল না, তাঁঁরা ক্রমাগত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে হটতে ভারতের একেবারে পূর্বাংশে অরণ্যঘেরা ভূখণ্ডে এসে উপস্থিত হলো।  ছোটনাগপুর, ঝাড়খণ্ড, সিংভূম, ধলভূম-এর মতো বিস্তীর্ণ মালভূমি ও দুর্ভেদ্য অরণ্যাঞ্চল সেই মুহূর্তে দুর্বল, ছত্রভঙ্গ, রণক্লান্ত অসুরগোষ্ঠীর কাছে আত্মগোপনের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত স্থান হিসেবে যে বিবেচ্য হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

 

অন্যদিকে যেসব অসুরগোষ্ঠী ভারতের বাইরে যেতে সক্ষম হয়েছিল ক্রমে তাঁঁদের প্রভাব ও পরাক্রম এত ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যে প্রায় তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে ব্যাবিলনের কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমাংশে তাঁঁরা অসুর বা আসিরিয়া(Assyria) নামে একটি সুবিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করে। টাইগ্রিস নদীর উর্বর উপকূল অঞ্চলে গড়ে ওঠে এদের সুরম্য রাজধানী। এশিয়া মাইনর থেকে ককেসাস্ পর্বত পর্যন্ত এদের অধিকার বিস্তৃত হয়। এই আসিরীয় জাতির প্রাচীন সভ্যতার যে নিদর্শন পাওয়া যায় (মেসোপটেমিয়া অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত তাম্রনির্মিত সুরাপাত্র, এছাড়া ভাষাসমূহের ব্যবহার) তাতে প্রমাণ করা যায় এই সভ্যতা অনেকাংশেই সুমেরীয়দের কাছে ঋণী। অনেক  ঐতিহাসিকদের মতে, সুমেরীয়রাই দ্রাবিড় জাতির বিবর্তিত রূপ, অন্তত উভয় জাতির ব্যবহৃত ভাষা ও লিপিসমূহে তেমনই ইঙ্গিত মেলে। একটা বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে দ্রাবিড়রা ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন জনজাতি। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ Sir William Turner প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রমাণ করেছেন যে, দ্রাবিড়রা বহু আদিমকাল থেকেই ভারতবর্ষের অধিবাসী। সেক্ষেত্রে অসুর সভ্যতার একটি বৃহদাংশ যে প্রাচীন ভারতীয় জনজাতি এবং বহিরাগত আর্যরা তাঁঁদের পরাজিত করে ভারতের বিস্তীর্ণ ভূমিভাগ দখল করেন- এ তত্ত্ব যথেষ্ট প্রামাণিক বলে বোধ হয়।ব্যাবিলনের ল্যাগেশ নগরের তেল্লা(Tella) নামক স্থানে মাটির স্তূূপ থেকে কারুকার্যখচিত যে প্রাচীন রূপোর পাত্র, তাম্রদ্রব্য আবিষ্কৃত হয়- ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণাংশে অরণ্যাঞ্চল থেকে সেই একই আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সমন্বিত তাম্রযন্ত্র উদ্ধার হয়েছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সেখানকার স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, সেখানে অসুর জনজাতির রাজা মহিষাসুরের শাসন ছিল; খুব সম্ভবত আরও দক্ষিণে মহীশূর ছিল তাঁঁর রাজধানী। সপ্তসিন্ধু থেকে বিতাড়িত হয়ে অসুুুর সম্প্রদায় দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের গঙ্গা বিধৌত অরণ্যভূমিকে নিজেদের বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সেখানে ভারতের সবচেয়ে আদিম অনার্য জনজাতি কোল, ভিল, হো, মুুুণ্ডাদের সঙ্গে অসুরদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় একটি মিশ্র সংকর জাতির উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে হয়। কালক্রমে তাঁঁরা আবিষ্কার করল এই বিপুল বনাঞ্চল আসলে খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। বিশেষত লৌহ, তাম্র, স্বর্ণ, বক্সাইটের অজস্র খনি যে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একথা আজ আর কারোর অজানা নয়। অন্যদিকে গঙ্গার পলিযুক্ত উর্বর কৃষিভূমি ছিল আরেক লোভনীয় সম্পদ। এই সকল অফুরান বৈভবের মাঝে অসুদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা দেবতাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। মরু-অঞ্চল যুক্ত রাজস্থান, গুজরাট এবং বৃহৎ নদীহীন উত্তর-পশ্চিম ভারতে দেবতাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছিল। পুরাণে বর্ণিত দেবতাদের শ্রীহীন হওয়া ও দেবী লক্ষ্মীর পাতাল-প্রবেশ এই ঘটনাকেই সমর্থন করে। সমুদ্রমন্থন করে লক্ষ্মীর পুনরায় স্বর্গে ফেরত আসা স্রেফ একটা গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া কিছু নয়। অসুরদের দ্বারা মরু-অঞ্চল যুক্ত বৃহৎ নদীহীন, কৃষিহীন উত্তর-পশ্চিম ভারত (পুরাণে বর্ণিত অমরাবতী/স্বর্গ) আক্রমণের কোন যুক্তিযত কারণ পাওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে আজকের দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব অঞ্চলগুলি তৎকালীন সময়ে এত উন্নত ও জনাকীর্ণ ছিল না। বরং গঙ্গা-দোয়াবাঞ্চলের কৃষিজমি, বনজ সম্পদশালী ভূভাগ এবং বিপুল খনিজ ভাণ্ডারের লোভে দেবতাদের দ্বারা বারংবার অসুররাজ্য (দক্ষিণ-পূর্ব ভারত) আক্রমণের তত্ত্বটি অনেকবেশি যুক্তিসম্মত বলে মনে হয়। এমনই একটি লোকশ্রুতি- যা মধ্যপ্রদেশ, বাংলার উত্তরবঙ্গ, সিংভূম, ছোটনাগপুর অঞ্চলগুলিতে বহুলভাবে প্রচলিত তাতে জানা যায় সিংভূম থেকে গাংপুর স্টেট পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ তাম্রখনি (যা প্রত্নতত্ত্ববিদরা ১৯৪০-এর দশকে আবিষ্কার করেন) ছিল মহিষাসুরের শাসনাধীনে।  আজও স্থানীয় লোকেরা একে 'অসুরগড়' বলে উল্লেখ করে। এই বিস্তৃত অঞ্চল জবরদখলের জন্য দেবতারা বারবার আক্রমণ করলেও অসুরদের হাতে পরাজিত হয়। তখন উপায়ন্তর না দেখে 'দুর্গা' নামক এক রমণীর সাহায্য তাঁঁরা গ্রহণ করে। এই দুর্গা ছলে-বলে-কৌশলে-রূপে-দেহসৌন্দর্য্যৈ বীর অসুররাজকে প্রণয়াসক্ত করতে সক্ষম হয় এবং গভীর অরণ্য মাঝে সোহাগরত অবস্থায় নিরস্ত্র, অসতর্ক মহিষাসুরকে হত্যা করে। সেই কারণেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসুর জাতির লোকেরা আজও দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে আলো বন্ধ করে অন্ধকার রাত্রিতে ছিন্ন পোশাক পরিহিত হয়ে অশৌচ ও শোক পালন করেন। 

 

এই মহিষাসুরের সঙ্গে আসিরীয় সম্রাট অসুরবনিপালের যোগসূত্রকেও উড়িয়ে দেওয়া চলে না। প্রায় ৬৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে বিপুল পরিমাণ তামা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো, আসিরীয়রা তাম্র-প্রিয় জাতি তো ছিলই, তাঁঁদের ব্যবহৃত তাম্র-দ্রব্যে ভারতীয় তামার নানান বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করা গেছে। ভারত ও আসিরীয় অসুররা যে একই জাতি তা আরও কিছু তথ্য সহকারে প্রমাণ করা সম্ভব। প্রথমত, আসিরীয় অসুর সম্প্রদায়ের শ্মশান ছিল ডিম্বাকৃতি মৃৎপাত্রের মতো, স্থানে স্থানে গোলাকার। অন্যদিকে শতপথ-ব্রাহ্মণে দেখা যায় দেবতাদের শ্মশান ছিল বর্গক্ষেত্র, স্থানে স্থানে আয়তাকার। কিন্তু ভারতীয় অসুরদের শ্মশান ছিল গোলাকৃতি। 

 

"যা আসুর্য প্রাচ্যাস্ত্বদ যে ত্বৎ পরিমণ্ডালানি শ্মশানানি কুর্বতে।" 

                                                       - শতপথ-ব্রাহ্মণ (১৩.৪.১.৫) 

 

দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক Sclater ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসরণ করে দেখিয়েছেন, যে একজাতীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীদের পৃথিবীর পৃথক পৃথক ভূখণ্ডে থাকা সম্ভব নয়। হয় বিচ্ছিন্ন ভূ-খণ্ডগুলি সংযুক্ত ছিল অথবা একই সম্প্রদায়ভুক্ত প্রাণীর উৎসভূমি একটিই;  পরবর্তীতে হতে পারে জীবনচর্যার তাগিদে তাঁঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত থেকে রপ্তানিকৃত যে খনিজ ও বনজ সম্পদ আসিরীয় সাম্রাজ্যের জৌলুসকে মহামান্বিত করে তুলতে পারে; সেই বিপুল ধনভাণ্ডার ভারতীয় অসুর জাতিকে নিশ্চয়ই দরিদ্রতা দান করেনি। বরং অনেকবেশি বৈভব ও বিত্তের অধিকারী করে তুলেছিল। প্রকৃতপক্ষে এই অতুল ঐশ্বর্যের চমকে দেবগণের দ্বিতীয়বার পদস্খলন হয়। ফলস্বরূপ তারা প্রতিনিয়ত অসুরগোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে থাকে, বীরত্বের বদলে ছলনা ও মিথ্যাচারিতার আশ্রয় নিয়ে তাদের পরাজিত এবং বিতাড়িত করতেও সক্ষম হয়। নির্মিত হয় বিস্তৃত আর্যাবর্ত ও তার নিজস্ব ইতিহাস।  যাকে ধর্মগ্রন্থের রূপ দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে সমাজের একটি ঐতিহাসিক দিককে আবৃত করে রাখা হয়েছে। কারণ শত অপরাধ, অন্যায় সত্ত্বেও ইতিহাস এবং সমাজ, অস্ত্র তথা বিজয়ীর কর্তৃত্বকেই সর্বদা স্বীকার করে এসেছে।। 

 

                                     

 

তথ্যসূত্র: 

১. ঋগ্বেদ, অনুবাদ- রমেশচন্দ্র দত্ত।

২. Indian Malayia: contribution to the Carniology of the people of the empire of India, Sir William Turner 

৩. History of ancient indian religious texts, J.R. Carter

৪. Perspective in social and economic history of early India, R.S. Sharma 

৫. রচনাবলী (প্রথমখণ্ড), অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। 

৬. দেবতার মানবায়ন, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। 

 

                                     

 


জিৎ পাল-এর কবিতা

জিৎ পাল-এর কবিতা
 

কুমড়ো ফুলের আলো

 
১৪
অনেক কোকিল আছে বুলবুলি কানাকুবো
অথবা ছাতার পাখি চড়াই বাবুই
মাছরাঙা কাঠঠোকরা সব দেখা যায়
অথচ অনেকদিন গ্রামে কোনো কাক-ই দেখি না
 
প্রণবের বাবা মারা গেলে
দাঁড়িয়ে নদীর পাড়ে দু'হাতে খাবার নিয়ে
কতবার কা কা করে গেল
অথচ এলো না কোনো কাক
 
গ্রামের যেখানে যত কাক ছিল সব
উচ্ছিষ্ট সন্ধানে যেন শহরের দিকে চলে গেছে
 
শহরে যে কটি আছে কোকিল চড়াই
তাদেরও তো মাঝেমাঝে কাক বলে ভুল করে বসি
 

১৫
জমিতে লাঙল দেয়া শেষ হলে পরে
সমস্ত আগাছাগুলি তুলে ফেলা হয়
ফসলের মাঝে দেখি তবুও আগাছা
ফসলের থেকে দ্রুত বাড়ে
কৃষক নিড়ানি দিয়ে মাঝেমাঝে বিদে দেয়
তবু যেন আগাছা মরে না
আবার হঠাৎ করে এখানে ওখানে
                                    আগাছা জন্মায়
 
পৃথিবীতে আগাছার এত পরমায়ু !
 

১৬
শুভর মা আর ঠাম্মা দেখি প্রতিদিন ঝগড়া করে কখনও বা মৃদু আর কখনও বা তীব্র ঝাঁঝ বড় কানে লাগে
সকলে অভ্যস্ত হয়ে যাই ধীরে ধীরে
 
মাঝেমাঝে শুভর ঠাকুমা
রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়
বসে থাকে রাস্তার কিনারে, খেজুরতলায়
সন্ধ্যা হয়, ধীরে ধীরে রাত নেমে আসে
শুভ ও শুভর বন্ধু ঠাকুমাকে বারবার ডাকে
ঠাকুমারও খুব জেদ কিছুতেই ফিরবে না ঘরে
শুভ ও শুভর বন্ধু ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়
 
একটু রাতের দিকে শুভর মা আসে
একবার ডাকতেই সুড়সুড় করে চলে যায়
আমরা সবাই মিলে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরি
বুড়ির মুখেও খেলে জিতে- যাওয়া মৃদু হাসি যেন
 
 
আমাদের গ্রাম থেকে কেউ
বৃদ্ধাশ্রমে থাকে না এখনও

 
১৭
লটারি টিকিট কাটে প্রতিদিন
অনেক টাকার স্বপ্ন নিয়ে শুতে যায়
কিছুই মেলে না তবু পরদিন আবার আবার
বাইশ বছর ধরে হারুদাকে দেখি যে কে সেই
কিছুই বদল নেই লটারি টিকিট কেটে যায়
প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে লক্ষপতি হয়ে গেছে ভোরে
 
বাইশ বছর ধরে আমিও তো শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করি
প্রতিদিন শ্রেষ্ঠ এক কবিতা লেখার স্বপ্ন নিয়ে
হারুদার মতো বেঁচে আছি

            

 

 

 

বেবী পোদ্দার এর কবিতা

বেবী পোদ্দার এর কবিতা 

এই মায়া তোমার আমার



আমি তাকে দিতে চেয়েছিলাম পূর্ণিমার মায়া
আর সে অমাবস্যাকে নিয়ে চলে গেল 
অন্য এক রাস্তায়, অন্য এক গোলক ধাঁধায়

জীবনে তার বিয়োগ বলে ছিল না কিছু
বিয়োগের কথা ভেবে এক মুহূর্ত বিয়োগ করতে চায়নি কখনো
আমি যার কথা লিখছি সে কেবলই
আলো আলো করে বাঁচতে চেয়েছিল, আলোকে সঙ্গে নিয়ে নয়
                       

                      

কাছে না এসে দূরে যাওয়ার কথাই বলে গেলে 
ছেড়ে চলে যাওয়া কি এতটাই সহজ! 

বন্ধনের সুতো কি এতটাই ঢিলেঢালা!
মৃত্যুকে জয় করে বেহুলা এনেছিল যে জয়
তার অহংকারের টিকা আজও লেগে আছে
রমণীর কপালে

তুমি যদি ভাবছো সাগরের থেকে ঢেউকে ছিনিয়ে নেবে
সে ভুল
স্রোত যে দিকেই বাঁক নিক
ঢেউকে সঙ্গে নিয়েই বয়ে চলে সে

 


বিয়োগের যন্ত্রণা বুঝতে চাওনি কখনো
যোগের আনন্দেই মেতে থাকলে সারাটা জীবন
যদি বুঝতে, তাহলে আজ
আর একটু থেকে যাওয়ার কথা বলতে
থেকে যাওয়া মানে আরও বেশি নৈকট্যের চিহ্ন রেখে যাওয়া
হৃদয় নদীর স্রোতে যে গভীরতা
যদি বুঝতে
ডুবে যাওয়ার ভয়ে নয় ভেসে থাকার আনন্দে
বেঁচে থাকতে লোভ হয় না তোমার!
 

   

ভাবো আমিই জোনাকির আলো 
তোমার গাঢ় অন্ধকারে আমার সামান্য উপস্থিতি কত উজ্জ্বল
কত মায়াবী
তুমি তো জানো মানুষ যখন ভাসতে থাকে 
তখন খড়কুটোও বেঁচে যাওয়ার একমাত্র সম্বল হয়ে ওঠে
তোমার আলোহীন ওই উঠোনে
আমিই হয়ে উঠতাম তোমার মায়াজোৎস্না


কেশব মেট্যা'র কবিতা



কেশব মেট্যা'র কবিতা

বিড়ালনামা-১

কোথাও গান নেই। হুম। উল্লাস।
গাছপালা কমলেও কমছে না জঙ্গল।
ভেতরে ভেতরে ঝোপঝাড়। গোপন বোঝাপড়া।
বিড়াল ঘুরছে। এদিক ওদিক।
যারা ঘন্টা বাঁধবে বলে বাড়ি ছেড়ে বাইরে গেল,
তারা বিড়াল হয়ে ফিরে আসছে।
উঁকি মারছে বাঘের মতো।

কোথাও গান নেই। 
শুধুই ঝোপঝাড়। গোপন বোঝাপড়া।



বিড়ালনামা-২ 

বিড়ালের লাফ।

তোমার মাথায় চিন্তা।
রান্নাঘর মনে করাচ্ছে মাছ;
মাছ কিছুই মনে করছে না। মরা মাছ।

কড়াইতে গরম তেল ফুটছে
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে গাল, মাছের।

এসব মুগ্ধতা বিড়াল জানে না,
শুধু সুযোগ বোঝে।



বিড়ালনামা-৩ 

রাজনীতি আজকাল দৈত্যের মতো চেপে বসে
সাধারণের পেশীতে।
অসাধারণ অঙ্গুলি হেলনে
মানুষ
রাস্তা বাঁধে
আবার রাস্তা কাটেও।

এই রাস্তা কাটার গল্পে হিরো হয়েছে তেখালি ব্রিজ–
আর হিরোইন নন্দীগ্রামের কলতলা।

মানুষ রাস্তা কাটে রাজনীতির কালো ছায়ায়।
আর বিড়াল কাটলে, ডেঞ্জার।
ইতিহাস ভূগোল ভুলে সব্বাই কষে ব্রেক!



বিড়ালনামা-৪ 

রিসেপশন সেরে বাড়ি ফেরে তারা;
রঙিন আলোয় কত কিছু ঢাকা পড়ে যায়।

রাত দুটো
বিছানা ভর্তি ফুল
ফুলশয্যা।

জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে। সাদা ধবধবে।
চাঁদ নয়... চাঁদ নয়...
একটা বিড়াল।

মেঝেতে বমি করে।
গরগর করে। হঠাৎ হঠাৎ।

বউ ভাবে– পূর্ব প্রেমিক তার
মদ খেয়ে কষ্ট ভুলতে চায়।
বর ভাবে–পূর্ব প্রেমিকা নাকি
পেটে কি তবে সত্যি কিছু...

রাত বাড়ে।
হাততালি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে চাঁদ।
একটা ফুলসাজানো খাট সারারাত জেগে থাকে চুপচাপ!



কলঙ্ক 

সমুদ্রে গিয়েছিলাম।

চরাচর জুড়ে দুধসাদা জলরাশিকে
জ্যোৎস্না ভেবে,
চাঁদ খুঁজেছি চাঁদ...।

ঢেউয়ে যারা বেদনা ভাসাতে যায়–
কী নিয়ে ফেরে হে বালুর দেশ?

কৃষ্ণবর্ণে ফিরে এলাম রাধে
কলঙ্ক খুঁজলে না যে!



 ফু-১

বাতাস অ্যাডমিশন নিয়েছে। কলেজে।
অন্ধকারে অনার্স।

এত দীর্ঘ তার সিলেবাস,
সে ঝড় হয়ে ফিরে আসে।



ফু-২ 

যারা সমুদ্রে ঢেউ মাখতে যায়
বাতাসকে অগ্রাহ্য করে কি?

সেও নারী এক
তছনছ করে– নতুবা বিলি কেটে দেয়।



দিনযাপন-৯ 

ঘুড়ি। লাট খাচ্ছে। আমিও।

শৈশব ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ...

ফুরোবার পথ নেই আজকাল,

হদিশ পেলেও
হাততালি নেই।

হাতে জড়িয়ে আছে ষড়যন্ত্র...

পায়ের নীচে ফাঁদ,

ঘুম...



দিনযাপন-১০ 

কী দারুণ সম্মোহিত করেছ আমায়,

ঘুম এলো। সত্যি ঘুম।
বহুবছর পর...

কার হাতে হাত রাখছি,
সরিয়ে দিচ্ছি কার ঠোঁট...
বুঝতেই পারছি না
জানতেও কি চাইছি...

ঘাম গড়িয়ে যাচ্ছে
উপর থেকে নীচ
উপুড় থেকে চিৎ।

আলো জ্বালালো কে
হঠাৎ!

আয় ঘুম আয়
মিথ্যে মিথ্যে ঘুম,

আর ভাঙবে না
অনেক বছর।

যাদুকর রিলিফ চাইছে কেন? রিলিফ।
যাদুকরও রিলিফ চায়..রিলিফ!


দিনযাপন-১১ 

সহজভাবেই যাকে পাওয়ার ছিল...
হারিয়েছি কি সহজভাবেই?

কাছে যে আসছে
গায়ে তার দ্বিধা,
জড়িয়ে আছে আবেশ...

আমার চোখ ছোটো হয়ে আসছে 
কেন...?

মন নীচের দিকে গড়িয়ে গেলে,
ছোটো হয়ে যায় বুঝি চোখও!

সহজভাবেই যাকে পাওয়ার ছিল...
দেখি হারায়নি
হারায় না তা সহজে।


দিনযাপন-১২ 

কলঙ্ক কুড়োচ্ছি দিনরাত।
পরিচিত অভিমান আর নেই...
কূল জুড়ে শুধুই লাল চক্ষু, ঝড়ের আভাস।

রাঙিয়া উঠিল দিনমান...
ভাঙিয়া পড়িল আকাশকুসুম।

রক্তমাংসের মনুষ্য কম্পন খুঁজতে গিয়ে দেখি–
ঘুম ভেঙে দাঁড়াচ্ছে দেওয়াল।
দেওয়ালে দেওয়ালে... বিষাদডানার ঢেউ।
দেওয়াল জাগছে...

জাগছে না মানুষের মতো কেউ!

 


একাদশীর গল্প


বেহুলা   


বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়   



বিশাল বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বেহুলা । গদাই  বলে  – অমন  ড্যাবড্যাব করে   কি দেখছিস  ? ভিতরে চল ।

‘ইয়া বড় ঘর , লোকজন নাই ?’    

- সবই কপাল রে বেহুলা । একসময়ের রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি ।  লোক লস্করে ভরে থাকত । আজ খাঁ খাঁ করছে ।  দেখার কেউ নাই । এরেই বলে বিধাতার লিখন ।  

থমথমে চারপাশ । ভাঙাচোরা  পুরানো রাজবাড়ির আদল । নোনা  দেওয়ালে লেখা অদৃশ্যলিপিগুলো দেখছিল বেহুলা ।কেউ যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।গদাইদা আসার সময়  বারবার বলেছে ভয় পাসনে যেন । একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে বলিস ভজুখুড়া লোক ভালো ।মাত্তর দুটো লোকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা  বললে ঠিক হয়ে যাবে ।বেতনও মন্দ লয় । টাকা পয়সার তো আর অভাব নেই লোকটার । অই যা ছন্নছাড়া অবস্থা ।বেহুলা দেখতে পাচ্ছিল কী যেন নেই বাড়িটায় । ছিরিছাঁদ । শুধু কি দেওয়াল আর উঠোন। সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে ।ছেলে দেখেনা । মেয়েও খবর নেয়না । শুধু পয়সা পয়সা , ধন দৌলত করতে গিয়ে ধ্বসে গেছে পুরো বাড়িটা ।

                 লম্বা উঠোন । চারদিকে ঘাস জমে আছে । মাঝে সরু সিঁথির পারা ক্ষীণ পায়ে চলা পথ ।সেই পথে পায়ে পায়ে হেঁটে আসতে আসতে গদাই বলে যাচ্ছিল – ‘গরীবের রক্ত চুষা পয়সা । বড় পাপের পয়সা রে বেহুলা । বন্ধকী কারবার , সুদের কারবার, দাদনের কারবার মানুষকে যেমন ফুলায় ফাঁপায়  সেরকম একদিন সব রক্ত চুষেও লেয়।‘

                          নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে বেহুলার মনে হল কত মোড় আর চৌমাথা রাস্তা পেরিয়ে এসেছে  তার ছত্রিশ বছরের জীবন ।দুঃখ বারবার থাবা বসিয়েছে । মন ছিচ্ছাতুর হয়ে গেছে । তবু  শরীরের উপর তার কোন  দাগ পড়েনি । অভাবে দারিদ্রে আর দুঃসময়ের উপর দিয়ে এলেও তার  গা গতরে বাইশের আভা । রঙ টসটসে পেয়ারার মতো।একটা বিয়ে হয়েছিল কম বয়সে। লোকটার স্বভাব চরিত্তির ভালো ছিলনা।মারধোর করত বিনা কারণে। নিজে মদ গিলে পড়ে থাকত ঘরে আর দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হত বেহুলাকে ।বাড়ি ফিরলেই খেঁকিয়ে উঠত হরেন  – মদ আইনেছিস হারামজাদী ? দিনের শেষে বেহুলার পেটে তখন খিদের বাঘটা ছটফট করত । সারা শরীর তেতে থাকত ক্লান্তিতে।পিত্তি জ্বালনো কথাগুলো গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিত –  বিষ খা শুয়ারের বাচ্চা ।   

–‘সারাদিন করিস কি ? কেবল মরদলোকের সাথে ঢলানি । মাইরে হাড়গোড় ভাইঙ্গে দিব ।‘শুধু কথায় নয় কাজেও তা  করে দেখাত হরেন তবু ভাব ভালোবাসার চেষ্টা করেছিল ।  কিন্তু লোকটার শরীরে ভাব সাব নেই । খালি ফুর্তির নেশা  ।আটকাতে পারেনি তাকে। ভাব ভালোবাসা না হলেও কিছু তো আটকায় না।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল জুড়ে একটা ব্যাটা ছেলে এসেছিল । বেঁচে থাকলে জোয়ান বয়স হত এতদিনে । তার শোক ভুলতে পারেনি বেহুলা ।তিনদিনের জ্বরেই ছেলেটা কাহিল হয়ে গেল । হাসপাতালের ডাক্তারেরা বলেছিল – ডেঙ্গি । বড় দেরি করে ফেলেছ বেহুলা । দুদিন আগে এলেও চেষ্টা করতে পারতাম । এখন ভগবানই ভরসা । ভগবানের নাম জপ করতে করতে দুদিন আরও কাটল । কত মানত করল , কত মানসিক করল । বাবা সদাশিব ওদের গাঁয়ের জাগ্রত দেবতা  তাকে কেঁদে কেঁদে কত ডাকল । তবু সদয় হলনা বুড়াবাবা । ছেলেটা নেতিয়ে যেতে লাগল ধীরে ধীরে ।  কোন সাড়াশব্দ নেই ।মরবার আগে মায়ের হাতটা জোর করে খামচে  ধরেছিল বাচ্চাটা , কোনমতে ছাড়তে চায়নি । এখনও মনে হয় আরও দুদিন আগে যদি সে যেতে পারত ।

দরজার কড়া দুটো জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে গদাই বলল – ভজু খুড়া , দরজাটা খুল । দেখ কাকে লিয়ে এসেছি ।   কড়া নাড়ার তীব্র ধাতব শব্দে ভাবনটা ছিঁড়ে গেল বেহুলার ।          

ভজহরি চক্কোতি মানুষ খুব ভালো । যেমন নরম মন তেমনি দয়ার শরীর । বেহুলাকে দেখেই বলল – তুমারে দেখে  কেমন মায়া হয় গো । লক্ষ্মী পিতিমার মতন মুখ । চোখে টলটল করে দীঘি ।  খুব ভরসা  হয়  তুমারে দেখে । আজকাল তেমন বিশ্বাস করার মতন মানুষ আর কই ।  বেহুলার  মনে হয়েছিল এত ধন দৌলত থাকা সত্ত্বেও লোকটার মুখে দুখের ছাপ । বেদনার কথা শুনতে পাচ্ছিল সে । যে ঘরটায় বসে তারা কথা বলছিল  সেখানে   ঠিকঠাক ঝাঁট পড়েনি কতদিন । ময়লার সর পড়েছে দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলির গায়ে । বেহুলার ইচ্ছে করছিল সব ময়লা ধুয়ে ঘরদোর ঝাঁ চকচকে করে দিতে ।

আপনি একলা থাকেন ?  

মাথা নেড়ে ভজহরি বলল – একা  মানে ? হ্যাঁ  একাই। ছেলে বিদেশে থাকে বাপকে দেখার সময় কই তার । আজ   চার বছর হয়ে গেল  একবারের জন্যও দেখিনি তাকে ।চোখের মধ্যে এক অসাহায়তা লুকোতে পারছিল না গোবর্ধন ।

সেই মরে যাওয়া বাচ্চাটার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল বেহুলার । সেও কি বিদেশে ? কোন দেশ ?  যেখান থেকে আর আসা যায় না । শুধু স্বপ্নের ভেতর হাত নাড়তে নাড়তে এসে সে তাকে ডাকত  মাঝে মাঝে  ।  নিশিডাকের মতো সেই ডাক বিহ্বল করে দিত বেহুলার শরীর । ঢেউ উঠত মনে । ঢেউ মিলিয়ে যেত ।ঘরের মানুষটার  দিকে তাকিয়ে কেমন ঘেন্না হত বেহুলার । এই শোক তাকে ছুঁতে পারে নি । সবসময় সে একটা হাত খুঁজে বেড়াত । হরেনের ভরসা দেওয়া হাত । কিন্তু পেত না । বেপাড়ায়  মদ আর গাঁজার আড্ডায় টইটম্বুর হয়ে থাকত সারাদিন । কান্না নদী হয়ে  বইত বেহুলার চোখে । অভিমানগুলো তীরের ফলার মতন বেরিয়ে আসত এক এক সময় – তুমি আমার কন কম্মে লাগ শুনি । সারাদিন মদ মাইরে পইড়ে থাক। তাও জগান দিতে হয় আমাকে ।   

-হারামজাদি , মদের খোটা দিবি না বইলে দিছি ।   

-হিম্মত আছে ত নিজের পয়সায় খাও । আহা মিনসের মুরাদ কত আমার জানা আছে । দুপয়সা নাই ঝুলিতে লাফ পাইড়ছে কুলিতে ।

-মেলা বাজে বকিস না ত ।   

-কি আমি বাজে বকছি ? তুমার জন্যিই আমার ছিলাট  সাত সকালে চইলে গেল ।টাকা থাইকলে ওরে আমি ঠিক বড় হাসপাতালে লিয়ে যাইথম ।

- তাও বাইচত নাই । তুর লজর ট খুব খারাপ । তুই ডাইন আছিস বেহুলা ।  

থরথর করে কেঁপে ওঠে বেহুলার পা তলের মাটি – ই কি বইলছ তুমি ?

আমি ঠিকই বলছি । তুর বিষ লজরে সারা শরীরে আমার জ্বলন হয় । ছিলাটার রক্ত খাইয়ে তুর খিদা মিটে নাই , লে   ইবরে আমাকেও খা ।

সেদিনই এক কাপড়ে  বেরিয়ে এসেছিল বেহুলা । আর ফিরেও তাকায় নি হরেনের দিকে । তারপর  বাপের বাড়ির ভাঙা চালাঘরে এসে উঠলে মা খেঁকিয়ে উঠেছিল –মিয়ালককে কত কিছু মাইনে লিতে হয় । ই ত সামান্য ব্যাপার । মাথায় দপ  করে আগুন জ্বলে উঠেছিল রাগে । গলায় কলসি বেঁধে নদীর  জলে ডুবে জীবনটাকে জলেই মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল  বেহুলা । পারেনি । লখাই এসে  টেনে তুলেছিল কয়েক ঢোক  জল খাওয়া শরীর – ছিঃ , ইভাবে কেউ লিজেকে আধ বেলায় শেষ করে ।

-কি হবেক ই জীবন লিয়ে  

-কত কিছুই ত শুরু হয় আবার লইতুন কইরে ।

-হয় না রে লখাই , পকায় খাওয়া ফুলে কি মালা হয় রে ।

 - লদীর জল হইল গঙ্গা । গঙ্গায়  ডুব দিলে সব শুদ্ধু হয় । আমি তোরে নাওয়ে চাপিয়ে দূর দেশে লিয়য়ে যাব ।  গাঁ  ছাইড়ে ভিন গাঁয়ে ঘর বাঁইধব ।  

নৌকা বাইত লখাই । পেশিবহুল হাতে নৌকার দাড় টানতে টানতে বলত – ই হাত ট ধর । জোর পাস ? মাথ নাড়ত বেহুলা । শুধু জোর  ?আর কিছু নাই ?

ভরসাও জাগত মনে । নদীতে বান এলে শক্ত করে ধরে থাকত হাতটা – আরে ছাড় ছাড় , অনেকদূর যাইতে হবেক ।

তুই আমারে ডুবাই দিবিস না ত লখাই ।

লিজে ডুইবে মইরব । তবু তরে ডুইবতে দিব নাই ।

বালাই ষাট , অমন কথা মুখেও আইনতে নাই ।    

অনেক পরে বেহুলা একদিন তাকিয়েছিল নদীর দিকে । এই নদীতেই  ডুবে যেতে চেয়েছিল সে । জল ডুবায় , মরায় আবার ভালোবাসার ছলাতছল শব্দ হয়ে  শস্যের আলপনা আঁকে ।না তার জীবনে শস্যের আলপনা আঁকতে পারেনি  লখাই।অনেক অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও শূন্য ঘরে সেই বাচাটাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি বেহুলাও ।বুক টন টন করত মাঝে মাঝে । তবু মনে হত লখাই মানুষটাকে নিয়ে সে তো সুখেই আছে ।  

কিন্তু সুখ তার কপালে নেই । কি যে একটা রোগ বাঁধাল লখাই । দিন দিন কেমন পুয়াল দড়ির মতন হয়ে যেতে লাগল তাগড়া গতর । অমন জুয়ান চেহারা  হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে এখন কঙ্কালের রূপ । ডাক্তার কী একটা ইংরিজি নাম বলেছিল অতসত মনে নেই বেহুলার । অনেক টাকা চাই । মাসে তিন চার হাজার টাকার ওষুধ ইঞ্জেকশন । তখনই সে  গদাইকে ধরেছিল – আমারে একট কাজ দিতে পার গদাইদা।

তুই আবার কি কাজ করবি ?

যে কোন কাজ ।  রান্নাবানার কাজ থেকে জুতো সেলাই সব পারি । আমার শুধু পয়সা দরকার ।  

ঘরের সব কথা খুলে বলেছিল গদাইকে । লখাইএর অসুস্থতার খুঁটিনাটি ।মানুষটা বড় ভালোবাসে গো দাদা ।জীবন ত আমারে কিছু দেয় নাই । শুধু এই একখানি চেরাগ ছাড়া ।

গদাই আশ্বাস দিতে পারেনি সেদিন – বলেছিল ঠিক আছে , আমি খবর দিব।  

 দেব দেব করেও অনেকদিন কেটে গেছে । বার কয়েক তাগাদা দিয়েছে বেহুলা ।  গদাইএর মনে পড়েছিল ভজহরি চক্কোত্তির কথা ।টাকা পয়সার তো অভাব নেই । জমি জায়গাও দেদার । লোকটাকে দেখার কেউ নেই । সদ্য বউ  মারা যাওয়ায় ছন্নছাড়া অবস্থা তখন তার  ।পাগলের মতন ঘুরে বেড়ায় , কোনদিন খায় , কোনদিন হয়তো সারাদিন খাওয়ার ইচ্ছেই জাগে না । কথাটা বেহুলার কাছে পাড়ব পাড়ব করেও  মনের ভেতর পুষে রেখেছিল গদাই । তারপর একদিন দেখা হতেই বলেছিল -  ভজুখুড়ার  একজন কেয়ারটেকার দরকার তুই কি রাজি আছিস  বেহুলা ?   কেয়ারটেকার শব্দটার মানে বোঝেনি বেহুলা ।  সে হ্যা না কি বলবে বুঝতে পারছিল না । থতমত খেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ।গদাই ওকে  আশ্বস্ত করেছিল- ঘাবড়াচ্ছিস কেন ? তেমন কিছু রাজকাজ নয় । বলতে গেলে কোন কাজই নয় । শুধু মানুষটাকে দেখা । আর টুকটাক বরাত শুনা ।

তাও কি  কি করতে হবে শুনি ?

তেমন কিছুই নয় । ওর তো কাজকম্ম করার লোকের অভাব নেই । কত কামিন মুনিষ  দুবেলা খাটছে । তুই শুধু  মানুষটার একটু যত্ন করবি ।

-যত্ন !

-হ্যা । এতে আখেরে তোরই লাভ । মাস গেলে হাজার পাঁচেক পাবি । তোরও একটা হিল্লে হবে ।

কথাটা মন্দ বলেনি গদাই মোহন্ত । বেহুলা সাতপাঁচ ভেবে দেখেছিল পাঁচ হাজার টাকা আজকের দিনেও খুব কম অঙ্কের টাকা নয় । এতে লখাইএর অসুধ পত্তরের ব্যবস্থা তো করা যাবে । গদাইএর প্রস্তাব তাই এককথায় লুফে নিয়েছিল বেহুলা – চল না গো গদাইদা । আজই ফাইলেন কথা বইলে আসি ।

ফাইলেন মানে ফাইন্যাল । গদাই গড়িমসি করে বলেছিল – আজই যাবি ? দুদিন ভাইবে দেখ ।

আমার অত ভাবাভাবি নাই হবেক । চল আজই যাই ।  

গদাই বলেছিল – যাবি যখন বলছিস তখন চল । আজ বেস্পতিবার কাশিপুরের হাটে যাব ভাইবেছিলাম একটা ছাগল কিনতে । সামনেই মনসাপুজা ।  

মনসাপুজা  ত এখন বহুত দেরি , লাও পরের হাটে যাবে তখন ।

বেহুলার কথা আর ঠেলে দিতে পারেনি গদাই । তাছাড়া ভজহরি চক্কোতিও সেই কবে থেকে বলে রেখেছে – একটা লিঝঞ্ঝাট  কাজের লোক  দেখে দিস বাপ । কোন পিছুটান নেই এমন মেয়েছেলে হলেই ভালো । দরদ দিয়ে সংসারটা  দেখবে । যত্ন করে রেঁধে খাওয়াবে ।  ঘরটার ছিরি ফিরবে । বউ চলে গিয়ে আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে    দেখতেই তো পাচ্ছ । ছেলে মেয়েরাও বিদেশ বিভূঁইএ থাকে । দু বছরেও আসার ফুরসত হয় না ।  

নির্ঝঞ্ঝাট বলতে যা বোঝায়  বেহুলা  তা নয় বরং তার ঝামেলা অনেক বেশি। তবু সবকিছু শুনে ভজহরির ভাল লেগে গেল । এর মধ্যেই চা এসে গিয়েছিল সঙ্গে বিস্কুট । বেহুলা বলল – চায়ের কি দরকার ছিল এত কষ্ট করে । বললে আমিই বানিয়ে দিতাম ।  

বিস্কুটে কামড় বসিয়ে ভজহরি বলল – সে দায়িত্বই তো এবার থেকে তোমার । আজ  কিন্তু অতিথি  । তাই যৎসামান্য আতিথয়তা ।

লোকটার দিলটা খুব বড় , বেহুলার মনে হল । আর হবে নাই বা কেন কত বড় ঘরের মানুষ । লোকের মুখে শুনেছে এক সময় একান্নটা পাতা পড়ত উঠোনে । ভিখারি লাগারি যারা আসত তারাও না খেয়ে ফিরে যেত না । সেই ঘরের মানুষ তার দিল কি আর পাঁচপ্যাচি মানুষের মতন হবে । পায়ে হাত দিয়ে লোকটাকে একটা পেন্নাম করার মন করেছিল বেহুলার । কিন্তু সাহস হয়নি । কত বড় মানুষ ।

কবে আসব কাজে ।  

কাজে আসার আগে মাইনেপত্তর ঠিক করে নাও

সে ত গদাইদা বলেছে ।

তাও তুমার মুখ থেকে শুনা দরকার ।

কত আর । এখনকার বাজার ত জানেন , জিনিস পত্রের যা দাম । পাঁচ হাজারের নীচে হয়না ।  

আচ্ছা । তাই দেব । কেয়ার টেকারের কাজ কিন্তু খুব মন দিয়ে করতে হয় । পারবে তো ?

খুব পারব । ঘাড় নাড়ে বেহুলা ।

তাহলে  আজ থেকেই  শুরু করে দাও ।

ঘরের মানুষটাকে নিয়ে আসব না ?

পরে কোন একসময় গিয়ে আনলেই হয় ।

একবেলার কাজেই ঘরটার ছিরি ছাদ ফিরিয়ে দিল বেহুলা ।ঝরঝরে বাতাস বইছে এখন । দম আটকে যাওয়া গুমোট ভাবটা চলে গেছে । দিনের আলো মরে যাচ্ছিল । বেহুলা বলল – আজ চলি  দাদাবাবু । লোকটা হয়তো উপাস করেই বসে থাকবে আমার জন্যি ।     

অনেক বলে কয়েও লখাইএর জায়গা হয়নি  বাবুবাড়িতে । সাফ বলে দিয়েছে – বেতন যা লিবি লে , আমার কনহ আপত্তি নাই , দুবেলার খাবারও লিয়ে যা  কিন্তুক রুগী মানুষ তার বহুত ঝামেলা ঝঞ্ঝট আছে। বেহুলাও বুঝেছে । বাবু  তো আর গাড্ডায় পড়েনি যে যা বলবে সব শুনতে হবে ।  কাজ সেরে সাঁঝের বেলা ঘরে ফিরলে সে দেখে মানুষটা গোগাচ্ছে ।  

  কাতরালে মানুষটাকে তখন আর চেনা যায়না  । কাটা ছাগলের মতন ছটফট করে, আছাড়ি পিছাড়ি খায় । কেঁদে সারা পাড়া জাগায় বেহুলা – অগো আমার কি হল । মানুষটা বিছনার লে   উইথতে লাইরছে  । তুমরা আইস্য ।  মা মনসা গ , তুমি সব বিষ লিয়ে লাও ইয়ার শরীল থাইকে , তুমার পায়ে পড়ি মা ।

-কাঁদিস না , বেহুলা । আমার বেলা ফুরাই আইসছে । তর লাইগে বহুত দুখ হয় রে তকে পাইয়েই পাইলম নাই ।

-চুপ যা , অমন কথা বলিস না । আমি লিজের জীবন দিয়েও তুকে বাঁচাব ।   

হাড় জিরজিরে চেহারার দিকে তাকিয়ে সে দেখে তাল পাতার  মাদুরে লেপটে আছে লখাইয়ের শরীর । কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখে এখনও লিকপিক করছে লড়াকু আলো  – আমি আবার নৌকা বাইতে পারব , বল ।  

-পাইরবি । খুব পাইরবি । তুর নাওয়ে বইসে ভাদু গান গাইব আমি ।  তার লাইগেই ত ।

ত্যাবড়ানো গালে নেমে এসেছে তিন চার ফোটা চোখের জল । বেহুলা  শাড়ির খুঁট দিয়ে আলতো করে মুছে দেয় দাগ – চল এখনই তুকে হাসপাতালে লিয়ে যাব , আবার ।

হাসপাতালের নাম শুনলেই  মুখটা আরও শুকিয়ে যায় লখাইয়ের  - বহুত যন্তনা হয় , মনে হয় আগুন জাইলে দিয়েছে আমার সারা গায়ে ।

হক । তবু লিয়ে যাব । তুকে বাইচতে হবেক ।  

এই হাসপাতালে চিকিৎসার তেমন সুযোগ নেই ।  ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছে তুমি ঠাকুরপুকুর বা বোম্বে নিয়ে যাও ।খুব তাড়াতাড়ি । যত দেরি করবে তত প্রাণের আশা কম । আজ বাবুকে সব কথা খুলে বলতে হবে । পয়সার খুব দরকার তার ।

তাই সকাল সকাল চলে এসেছে কাজে । কথাটা কীভাবে পাড়বে খুঁজে পাচ্ছিল না সে । নিজের মনের ভেতর হাতড়ে   যাচ্ছিল । তবু সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারছিল না । অথচ পয়াসার খুব দরকার তার । আগাম নিয়ে খেটে খুটে যেভাবেই  হোক গতর খাটিয়ে  শোধ করে দেবে সে । কিন্তু বাবু এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি । অন্যদিন সকাল সকাল উঠে গাছে জল দেয় । সুন্দর এক বাগান বানিয়ে নিয়েছে এই কদিনে ।

চা বানিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখল কোন সাড়াশব্দ নেই মানুষটার ।  থমকে দাঁড়াল বেহুলা । জানলা দিয়ে  হালকা আলো আসছে ঘরে ।  সকালের  মায়াবী আলোয়  সবকিছু ঝাপসা এবং রহস্যময় লাগে –   চা রাইখ্যে দিলম । বিছানার ভেতর থেকে  শরীরটা নড়ে উঠল  -  আমার শরীর ভাল নাইরে । মাথায় যন্তনা হইচ্ছ্যে   ।

হাত বুল্যায় দিব ।

দিবি । দে ...  

বিছানায় ভজহরি । জ্বরে না কি অদ্ভুত এক আবেশে  তার  শরীর কাপছে  । মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে টের  পেল  বেহুলা । শরীরে এক অদ্ভুত শিরশিরানি হচ্ছে  । কতদিন এরকম  হাতের পরশ পড়েনি । এক মেয়েলি গন্ধে ভরে আছে ঘর । জ্বর  বাড়ছে না জ্বর নেমে যাচ্ছে গা থেকে ভজহরি বুঝতে পারেনা । নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে ঝরে পড়ছে । এক রহস্যভরা মৃদু বাস্প  উঠেছে বেহুলার শরীরে । তার কোমল ভূখণ্ডের মধ্যে যতখানি  কলা কুশলতা আছে সে তার সমস্ত অস্ত্র প্রয়োগ  করবে আজ । সে প্রস্তুত হচ্ছে নৃত্যের  ভঙ্গিমায় । মেলে দিচ্ছে মায়াবী বিভঙ্গে । আলো এসে এসে পড়ছে উপত্যকায় । অদ্ভুত নৃত্যে দুলে উঠছে স্তনবৃন্ত । এগিয়ে আসছে , এই তো এগিয়ে আসছে  হাতটা এগিয়ে আসছে  বেহুলার ভরন্ত  বুকে  মুগ্ধতার দৃষ্টি  লাফিয়ে নামছে  ।কোন প্রতিরোধের আগল দিতে পারছেনা বেহুলাও ।  তার জমি কেঁপে উঠছে । প্লাবন আসা নদীর মতো সে  ভাসিয়ে দেয় সমস্ত উপকূল ।  কালনাগিনী সাপটা কি যেন  খুঁজে বেড়াচ্ছে বেহুলার এদিক ওদিক। সেই ছিদ্রপথ যা দিয়ে সে প্রবেশ করবে  লোহার বাসর ঘরে  । দীর্ঘশীত পেরিয়ে বসন্তের উত্তাপ পায় ভজহরি । খৈনি খাওয়া ঠোঁটে  চঞ্চল হয়ে উঠে নিমেষে । কানায় কানায় ভর্তি  নদী হয়ে যায় বেহুলা – নাও ভাসাও মাঝি , নাও ভাসাও ।  

ভেসে যাচ্ছে সে  ভেসে যাচ্ছে এক অলৌকিক পিচ্ছিলতায় । সাপটা হিস হিস শব্দে এগিয়ে আসছে গোপন ছিদ্রের  দিকে ছোবলের পর ছোবল  । এত জ্বালা এত আনন্দ সে গরলে ।  বিষ ঢালতে ঢালতে  একসময় থেমে যায় সাপটা । বেহুলা  জাঁতি ছুঁড়ে তাকে মারেনা, আশ্লেষে ভেসে যায় নৌকাবিহারে ।

তুই আমারে যে সুখ দিলি বেহুলা । আমি আমার সবকিছু তোকে দিলম ।

সবকিছু লয় , আমাকে খালি একলাখ টাকা দাও ।  আর বেশি কিছু চাইনা গ ।  মানুষটারে বাঁচাব  আমি ।

  ৩

ঘরে ফিরে গিয়ে বেহুলা  দেখে সব চীৎকার থেমে গেছে লখাইয়ের । কেমন  ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে । সমস্ত আর্তনাদ সমস্ত নিস্ফল আওয়াজ সে হজম করে নিয়েছে একা । ফসলকাটা ফাঁকা মাঠের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে সারা ঘর ।  

‘’এই দেখো তুমার জিয়নকাঠি ‘’। টাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে বেহুলা বাতাসের দিকে ছুড়ে দেয়  তারএকমাত্র স্বপ্ন । প্রতিধ্বনি হয়ে শব্দটা ফিরে আসে তার বুকে । তবু কোন আলোড়ন নেই , উথালপাথাল নেই । শূন্য কঙ্কালসার বুকের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বেহুলা –‘’ তুই আর কয়েকঘন্টা আমার লাইগ্যে দাঁড়াতে লারলি । এত তাড়া তুর । ‘’ বেহুলার  গলায় আর কোন রা নেই । বোবা হয়ে গেছে সে ।

একসময় থেমে যায় বোবা হাহাকার ।  চোখের জল শুকিয়ে গেলেও ঘা শুকোয় না । সে বাবুর বাড়ি  যায় আবার । ভজহরি খুশি হয় তাকে দেখে – কি করবি বল । যার যদিন ই দুনিয়ায় । জীবনের সুখ দুখ  ত আমাদের হাতে লয় । বাঁচার লাইগ্যে কাজ ত কইরতেই হবেক ।  

আমি আর কাজ করব নি বাবু ।

হতবাক হয়ে যায় ভজহরি –তবে  আলি কেনে ?

-তুমার পয়সাটা দিতে ।  মানুষের সপুন দেইখাবার চইখ না থাইকল্যে  বিজলিবাতি জ্বাইল্যে আর কি হবেক ।


লাখ টাকার বান্ডিলটা টেবিলে নামিয়ে রাখে বেহুলা ।